বৃহস্পতিবার, ৫ জুলাই, ২০১২

পুরনো ও নতুন প্রজন্মের দু’নেতার সঙ্গে আলাপচারিতা

আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী


সম্প্রতি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ লন্ডনে এসেছিলেন এবং দু’জনেই অনুগ্রহ করে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন এবং আমাকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ দিয়েছেন। কমিউনিস্ট নেতা মুজাহিদুল ইসলামের মনে দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যত নিয়ে একটা জেনুইন আশঙ্কার ভাব দেখেছি। আওয়ামী লীগের নতুন প্রজন্মের নেতা মাহবুবুল আলম হানিফের মধ্যে দেখেছি লড়াই করে টিকে থাকার একটা দৃঢ় অভিব্যক্তি। দেশের বর্তমান সঙ্কট উত্তরণে তাকে আশাবাদী মনে হয়েছে। 
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বাংলাদেশের একজন অভিজ্ঞ এবং পোড় খাওয়া বাম নেতা। স্বাধীনতা পূর্ব যুগ থেকে তিনি রাজনীতি করছেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী গত চার দশকের টালমাটাল রাজনীতির মধ্যেও কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) পতাকাটি দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে আছেন। তাকে অস্তিত্ব হারাতে দেননি। তার একটাই ভয়, বিরাট গণ-ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসার পরও আওয়ামী লীগ সরকার যেভাবে দ্রুত জনপ্রিয়তা হারিয়েছে এবং আগামী নির্বাচনে তার জয়লাভ অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে, তাতে দেশের বাম গণতান্ত্রিক শক্তি জোটবদ্ধ ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারলে সমূহ সর্বনাশ। বাংলাদেশে পাকিস্তান ও আফগান পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। 
আমি তার সঙ্গে সহমত পোষণ করি। আগামী সাধারণ নির্বাচনে যদি বিএনপির তথাকথিত ১৮ দলীয় জোটের জয়লাভ ঘটে, তাহলে ২০০১-০৬ এর বিএনপি জামায়াত সরকার ক্ষমতায় আসবে না। আসবে জামায়াত-বিএনপি সরকার। প্রকারান্তরে জামায়াত সরকার। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার যদি ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তাদের এবারের অবশিষ্ট মেয়াদে শেষ করে যেতে না পারে, তাহলে এই ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীদের আবার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন এবং স্বাধীন বাংলার পতাকা শোভিত গাড়িতে চড়া অসম্ভব ব্যাপার নাও হতে পারে। 
সবচেয়ে ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াবে এই জামায়াত সরকারের প্রতিহিংসা গ্রহণের নিষ্ঠুর রাজনীতি। আগামীতে নিষ্ঠুর নির্যাতনের খড়গ শুধু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী- সমর্থকদের ওপর পড়বে না, অন্যান্য গণতান্ত্রিক দল এবং গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমের প্রতি যাদের সামান্য আনুগত্যও আছে, তাদের সর্বাংশে নিপাত করা হবে। পঞ্চাশের দশকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে কাদিয়ানীবিরোধী দাঙ্গা ঘটিয়ে যে জামায়াত ৫০ হাজার নর-নারী হত্যা করে এবং একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যা ও গণহত্যায় শরিক হয়ে হাত পাকিয়েছে, তাদের পক্ষে সুযোগ পেলে এই দেশে আবার আরেকটি গণহত্যাযজ্ঞের অনুষ্ঠানে কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকবে কি?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম মনে করেন (অবশ্য আমি যদি তার বক্তব্য সঠিকভাবে বুঝে থাকি) আওয়ামী লীগের মহাজোটে যোগ দিয়ে একটি নিষ্ক্রিয় ও উপেক্ষিত শরিক হয়ে থাকার পরিবর্তে দেশের বাম গণতান্ত্রিক দলগুলোর উচিত, ছোটখাটো তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ভুলে একটি শক্তিশালী গণসংগঠন (শ্রেণী সংগঠন নয়) গড়ে তোলা। তার উদ্দেশ্য হবে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়া নয়, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটানো নয়, বরং আওয়ামী লীগের ওপর গণতান্ত্রিক চাপ অব্যাহত রাখা এবং গণবিরোধী সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী চক্রগুলোর অভ্যুত্থান ঠেকানোর জন্য আওয়ামী লীগের একটি সহযোগী বাহু তৈরি করা। যে ভূমিকা ষাটের দশকের শেষ দিক থেকে নিয়েছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফ্্ফর)। তখন এই ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি মিলিতভাবে আওয়ামী লীগকে সঠিক পথে ধরে রাখার জন্য পাইলট বোটের ভূমিকা নিয়েছিল। আওয়ামী লীগকে ডানপন্থী বিচ্যুতিগুলো থেকে রক্ষা করার জন্য অনবরত দলটির ভেতরে ও বাইরে সাফল্যের সঙ্গে চাপ সৃষ্টি করে রেখেছিল।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের এই বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্ন মত পোষণের অবকাশ কম। তার কাছে আমার অনুরোধ, তিনি নিজেও আজকাল একজন শক্তিশালী কলামিস্ট। তিনি যেন তার এক কলামে এই বিষয়টি আরও ভালভাবে বিশ্লেষণ করে কিছু লেখেন। আমার নিজেরও ধারণা, আওয়ামী লীগ এখনও বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক সংগঠন বটে, কিন্তু দলটির মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আমলের লেফ্্ট অংশ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত এবং বর্তমান নেতৃত্ব ক্রমাগত ডান প্রতিক্রিয়াশীলতার বিচ্যুতির দিকে হেলছে। আগে সিপিবি ও ন্যাপ (মোজাফ্্ফর) শক্তিশালী দল ছিল। তারা আওয়ামী লীগের ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি দ্বারা দলটিকে সঠিক পথে থাকতে সাহায্য জুগিয়েছে। মণি-মোজাফ্্ফর ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম বন্ধু ও সহযোগী।
আজ মণি সিংহ নেই। মোজাফ্্ফর বয়সে নবতিপর এবং নিষ্ক্রিয়। সিপিবি এবং ন্যাপও সংগঠন হিসেবে খুবই দুর্বল। আগেকার বাইপোলার বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। আওয়ামী লীগের মতো মাল্টিক্লাস গণসংগঠন যাতে ক্রমাগত ডানে হেলতে না থাকে, তার রাশ টেনে ধরার কোন শক্তিশালী ও প্রগতিশীল সহযোগী সংগঠন আজ নেই। দলটির ভেতরেও নেই আগেকার দক্ষ লেফ্্ট বা প্রগতিশীল অংশ। দলের নেতা বঙ্গবন্ধু নিজেই ছিলেন একজন দৃঢ়মনা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নেতা।
তার একপাশে খোন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে একদল প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থী গ্রুপ ছিল বটে; কিন্তু অন্য পাশে ছিল তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে ততোধিক শক্তিশালী গ্রুপ, যাকে আমরা লেফট অথবা প্রগতিশীল বলতে পারি। এই দুই গ্রুপের মাঝখানে ড. কামাল হোসেনের মতো দোমনা, মধ্যপন্থীরাও ছিলেন। দলে তাদের কোন স্পষ্ট ভূমিকা ছিল না। 
বর্তমান আওয়ামী লীগের একমাত্র মূলধন বঙ্গবন্ধুর নাম এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্ব। শেখ হাসিনা নিজে সাহসী এবং অভিজ্ঞ নেতা। কিন্তু তাকে সাহায্য ও আরও সাহস জোগানো এবং সঠিক পথে ধরে রাখার জন্য কোন মিত্রপক্ষ দলের ভেতরে নেই, বাইরেও নেই। ভেতরে লেফট ফোর্স অস্তিত্বহীন এবং বাইরে বাম দলগুলো একেবারেই দুর্বল ও শক্তিহীন।
বর্তমান আওয়ামী লীগে এখন দু’শ্রেণীর নেতাকর্মীর প্রাধান্য। সত্তরের দশকে যারা দলের তরুণ নেতা ছিলেন তাদের অধিকাংশই এখন প্রবীণ ও নিষ্ক্রিয় (কেউ কেউ গতায়ু)। বর্তমানে যে দু’একজন প্রবীণ নেতা আওয়ামী লীগে আছেন বা মন্ত্রী হয়েছেন, যেমন নুরুল ইসলাম নাহিদ ও মতিয়া চৌধুরী তারা অতীতের বাম রাজনীতির লোক। দলে যে দু’শ্রেণীর নেতাকর্মীর এখন প্রাধান্য, তাদের মধ্যে ডান ও সুবিধাবাদী প্রবণতা বেশি। অভিজ্ঞতার বদলে চাটুকারিতা তাদের প্রধান সম্বল। দলে ও সরকারে এদের প্রাধান্য বিস্তৃত হওয়ায় বিরাট গণম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসা সত্ত্বেও দল ও সরকারের এখন এই লেজে গোবরে অবস্থা।
এই অদক্ষ অযোগ্য চাটুকার বাহিনী নিজেদের ব্যর্থতার দায়িত্ব অপরের কাঁধে চাপানোর জন্য এখন ‘আওয়ামী লীগ বামেরা দখল করে ফেলেছে’ বলে মিথ্যাবাদী রাখাল বালকের মতো চিৎকার শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকার প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর যে ক’জন মন্ত্রীর কর্মদক্ষতা ও সাফল্যের জন্য এখনও জনপ্রিয়তা কিছু ধরে আছেন, তাদের বিরুদ্ধেই এই চিৎকার ও প্রচারণা চলছে।
একথা সত্য, আওয়ামী লীগের যেসব নেতা বা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এখনও বামপন্থী থাকার অভিযোগ তুলে প্রোপাগা-া চালানো হচ্ছে, তারা এককালে অন্য বাম রাজনৈতিক দলে ছিলেন। কিন্তু দীর্ঘকাল হয় আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এবং বর্তমান মন্ত্রিসভায় তারাই বেশি সৎ ও যোগ্য মন্ত্রী হিসেবে বিবেচিত। এদের তাড়াতে পারলে দলই শুধু কানা হয়ে যাবে না; বর্তমান সরকারও তার অবশিষ্ট সততা ও যোগ্যতার সুনাম হারাবে। 
শেখ হাসিনা অবশ্যই তার দলে ডান সুবিধাবাদী এবং অনভিজ্ঞ চাটুকার এই দুই শ্রেণীর ক্রমাগত প্রাধান্য বুদ্ধি সম্পর্কে সচেতন। এরা এদের চক্রান্তে সফল হলে আওয়ামী লীগের অবস্থা যে বিএনপির সমপর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে, এ সম্পর্কেও শেখ হাসিনা সচেতন বলেই শুনেছি। তিনি সচেতন বলেই দল ও সরকারে এই ডানপন্থী দৌরাত্ম্য এখনও সম্পূর্ণ সফল হতে পারেনি। কিন্তু এদের শুধু ঠেকিয়ে রাখা নয়, আওয়ামী লীগ দল ও সরকারকে আবার জনসম্পৃক্ত এবং সংগঠিত প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের চরিত্রে ফিরিয়ে আনার জন্য শেখ হাসিনাকে সাহস ও শক্তি যোগানোর কোন সহযোগী বাহু তার পাশে নেই। দলের ভেতরে বাম গ্রুপ প্রায় অস্তিত্ববিহীন এবং দলের বাইরের বাম গণতান্ত্রিক দলগুলো খুবই দুর্বল ও শক্তিহীন।
এই অবস্থায় দেশে বাম গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং আওয়ামী লীগকে তার সঠিক নীতি ও আদর্শের পথে ধরে রাখার জন্য যে সহযোগী শক্তি গড়ে তোলার কথা চিন্তা-ভাবনা করছেন কমরেড সেলিম তার যথেষ্ট প্রাসঙ্গিকতা আছে বলে আমার মনে হয়। আওয়ামী লীগের যারা প্রকৃত নীতিনিষ্ঠ নেতা ও কর্মী এবং হিতাকাক্সক্ষী, আমার ধারণা, তাদেরও বিষয়টি বিবেচনা করে দেখা উচিত।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ সম্প্রতি একটি বক্তৃতায় বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের আরও দু’টার্ম ক্ষমতায় থাকা দরকার।’ কথাটা আমিই এক সময় বলেছিলাম। সুদীর্ঘকালের অগণতান্ত্রিক শাসনের ও অপশাসনের যে জঞ্জাল স্তুপাকৃত হয়ে আছে, তা দূর করে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে আওয়ামী লীগ সরকারের আরও দু’টার্ম ক্ষমতায় থাকা জরুরী।
এ রকম কথা বলেছিলেন ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিসেস মার্গারেট থ্যাচারও। তিনি প্রথম দফা ক্ষমতায় এসেই বলেছিলেন, ‘ব্রিটেনের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যে জঞ্জাল জমে আছে, তা দূর করে দেশটাকে সুস্থ ও স্বাভাবিক করে তুলতে হলে আমাকে তিন টার্ম ক্ষমতায় থাকতে হবে।’ ব্রিটেনের মানুষ তাকে তিন টার্ম ক্ষমতায় থাকতে দিয়েছিল। 
বাংলাদেশে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তাদের প্রথম টার্মে অনেক ভুল-ভ্রান্তি ও অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। এই ভুল ভ্রান্তি সংশোধন করে সঠিক পথে ফিরে আসতেও তাদের আরেকটি টার্ম এবং দেশকে সুশাসন উপহার দিতে পরবর্তী টার্ম ক্ষমতায় থাকা প্রয়োজন। শুধু সুশাসনের জন্য নয়, দেশকে বিএনপি-জামায়াতের তালেবানী চক্রান্ত থেকে মুক্ত রেখে গণতন্ত্রের পথে ধরে রাখার জন্যও আওয়ামী লীগ সরকারের আগামী নির্বাচনেও ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন প্রয়োজন। হানিফ সেই প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। কিন্তু কিভাবে এই ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন সম্ভব হবে তা বলেননি। সে কথা বলেছেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তাদের দু’জনের বক্তব্যই (্একজন পুরনো প্রজন্মের, একজন নতুন প্রজন্মের) দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার কাছে গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবনযোগ্য মনে হয়েছে।
[লন্ডন ৪ জুলাই, বুধবার ॥ ২০১২ ॥]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন