শনিবার, ৩০ জুন, ২০১২

পাঁচ নেতার শেষ জীবনের অপূর্ণ ইচ্ছা ও পরিকল্পনা



 আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী 
বেশ কিছুকাল আগে এক বন্ধু আমাকে একটি বই উপহার দিয়েছিলেন। বইটির নাম “লাস্ট ডেজ অব লেনিন” (লেনিনের শেষের দিনগুলো)। নানা কারণে বইটি তখন পড়া হয়নি। সম্প্রতি এক অবকাশ মুহূর্তে বইটি পড়া শুরু করে আর শেষ না করে পারিনি। বইটিতে লেনিনের শেষ জীবনের এমন অনেক ইচ্ছার কথা প্রকাশ করা হয়েছে, যা আগে জানতে পারিনি। আর এখনতো জানার উপায়ই নেই। সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের ব্যান্ড-বাদকেরা এমন একতরফাভাবে লেনিন, স্ট্যালিন, মাও প্রমুখ বিশ্ব কম্যুনিস্ট নেতার চরিত্র হনন শুরু করেছেন যে, এখন তাদের সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্যই জানা মুশকিল।
‘লাস্ট ডেজ অব লেনিন’ বইটি পশ্চিমা ধনবাদী শিবিরের বর্তমান প্রোপাগান্ডা শুরু করার আগের লেখা। ফলে লেনিনের শেষ জীবনের ইচ্ছা ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে এমন কিছু তথ্যভিত্তিক বিবরণ পাওয়া যায়, যা কেউ চ্যালেঞ্জ করেননি। একটি সোস্যালিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠার পরই লেনিন বুঝতে পেরেছিলেন, কঠোর তত্ত্বভিত্তিক প্লোরেতারিয়েত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। প্লোরেতারিয়েতরা (সর্বহারা) চিরকাল প্লোয়েতারিয়েত বা সর্বহারা থাকে না। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পর তারাও শাসক শ্রেণীতে পরিণত হয় এবং তাদেরও চরিত্র বদল হয়।
এই চরিত্র বদলের ফলে তারাও যাতে আগের ধনবাদী শাসকদের চরিত্র বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন না করে, সেজন্য তিনি কঠোর সমাজতান্ত্রিক একদলীয় ব্যবস্থার মধ্যেও হিউম্যানিজমের কিছু কিছু জানালা খুলে দিতে চেয়েছিলেন। হিউম্যানিজমের বৈশিষ্ট্যবর্জিত কম্যুনিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা দানব-চেহারা ধারণ করতে পারে এটা গোড়াতেই উপলব্ধি করে লেনিনের ভারতীয় সহকর্মী এম.এন রায় কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে ভারতে এসে মেডিক্যাল হিউম্যানিস্ট পার্টি গঠন করেছিলেন।
লেনিনের মৃত্যু-পূর্ববর্তী চিন্তাচেতনায় যে পরিবর্তন এসেছিলো, তা তিনি বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ক্রমে ক্রমে তিনি অবশ হয়ে পড়েন, তার বাকশক্তিও হ্রাস পায়। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় অনেক সময় ইঙ্গিতে অথবা কাউকে ডিকটেশন দিয়ে তার নির্দেশগুলো দিতেন। লেনিনের অসুস্থতার সময় তার দুই ঘনিষ্ঠ সহকর্মী স্ট্যালিন ও ট্রটস্কির মধ্যে গুরুতর মতবিরোধ দেখা দেয়। স্ট্যালিনই পলিটবু্যুরোতে অধিক ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন।
‘লাস্ট ডেজ অব লেনিন’ বইতে লেখা হয়েছে, লেনিন মৃত্যুর আগে যা চেয়েছিলেন, তা যদি বাস্তবায়িত হতো, তাহলে সোভিয়েট ইউনিয়ন একটি স্টেট ক্যাপিটালিজম ভিত্তিক কঠোর একনায়কত্ববাদী রাষ্ট্র হওয়ার বদলে ধীরে ধীরে এক ধরনের প্লুরালিস্টিক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে এগুতো এবং তার হিউম্যান ফেস বা মানসিক চেহারা হারাতো না।
কিন্তু স্ট্যালিন পরে লেনিনের অসুস্থতার সুযোগে এতো বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন যে, তিনি লেনিনের নির্দেশের পরোয়া করতেন না। তিনি পার্টি ও সরকারের অন্যান্য সদস্যের কাছে লেনিনের নির্দেশগুলো গোপন করে নিজের ইচ্ছাকেই লেনিনের নির্দেশ বলে চালাতেন। বাকশক্তি রহিত লেনিন মৃত্যুশয্যায় শুয়ে স্ট্যালিনের সব কার্যকলাপ লক্ষ্য করতেন। কিন্তু স্ট্যালিনের অনুচরদের দ্বারা সর্বসময় পরিবেষ্টিত অবস্থায় তার কিছুই করার ছিলো না। তিনি স্ট্যালিনের কার্যকলাপে বাধাদানের উপায় খুঁজেছেন। কিন্তু উপায় খুঁজে পাননি।
এই বইটি পাঠের পর কম্যুনিস্ট চীনের নেতা ও প্রতিষ্ঠাতা মাও জে দুংয়ের শেষ জীবনের ইচ্ছা-অনিচ্ছাগুলো জানারও আমার ইচ্ছে হয়। শুনেছি এ সম্পর্কে কয়েকটি বই বেরিয়েছে, কিন্তু আমি সংগ্রহ করতে পারিনি। মাও জে দুংয়ের জীবিতকালে লন্ডনের ‘দি ইকোনোমিস্ট’ পত্রিকা মাও জে দুংকে নিয়ে একটি দীর্ঘ কভার স্টোরি প্রকাশ করে, সেটি এবং পরবর্তীকালে চীন-বিশেষজ্ঞ কয়েকজন মার্কিন সাংবাদিকের লেখা পড়ার সুযোগ আমার হয়েছিলো। এগুলো পাঠ করে আমার মনে হয়েছে, মাও তার শেষ জীবনের ইচ্ছা পূর্ণ করে যেতে পারেননি। চীনে তার পরবর্তী কম্যুনিস্ট নেতারা মাওকে গ্রহণ করেছে, কিন্তু মাওবাদকে বর্জন করেছে।
 ‘দি ইকোনমিস্টের’ মাও সংক্রান্ত কভার স্টোরিতে চীনের কম্যুনিস্ট সরকার ও কম্যুনিস্ট পার্টিতে মাও বিরোধীদের সাথে মাওবাদীদের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের আভাস দেওয়া হয়েছিল। মাও তখনো জীবিত আছেন। তার অভিনেত্রী স্ত্রীকে ঘিরে তখনকার ‘গ্যাঙ অব ফোর’ (চারের চক্র) গড়ে ওঠে। মাওয়ের বিশ্বস্ত সহচর লিন পিয়াও খুবই শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, মাওয়ের পর লিন পিয়াও হবেন তার ক্ষমতার উত্তরাধিকারী। ‘দি ইকোনমিস্ট’ এই সম্ভাবনাকে সামনে রেখে তাদের কভার স্টোরির শিরোনামটি কভারেই বড় করে ছেপেছিলো। মুসলমানদের কলেমা তৈয়বের অনুকরণে তাতে নেয়া হয়েছিল ‘There is no Mao but Mao and lin piao is his prophet’ (মাও নেই, কিন্তু মাও আছেন এবং লিন পিয়াও তার পয়গম্বর)।
লেনিনের মতো মাও জে দুংও সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন একদলীয় দানব ব্যবস্থা দ্বারা সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রও টিকিয়ে রাখা যাবে না। এই চিন্তা থেকেই তিনি ‘let hundred flowers blossom বা শত ফুল ফুটতে দাও শীর্ষক তত্ত্বে সমাজতন্ত্রী সমাজে ভিন্ন মতের অবস্থানকেও মেনে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, চীনের নতুন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা এখনো মজবুত হয়নি এবং এই ব্যবস্থায় দুর্বলতার ফাঁকে ‘শত ফুল ফুটতে দাও’ থিয়োরির সুযোগ নিয়ে অধিক শক্তিশালী-ধনবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত কম্যুনিস্ট চীনকে ধ্বংস করতে পারে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে থিয়োরিটির বাস্তবায়ন বন্ধ করেন।
কিন্তু শেষ জীবনে মাও জে দুং আরেকটি সত্য অনুধাবন করেন।  যে কৃষক ও শ্রমিক এবং নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীকে সংঘবদ্ধ করে তিনি চীনে কম্যুনিস্ট বিপ্লব সফল করেছেন, সেই কৃষক-শ্রমিক শ্রেণী বা তাদের  প্রতিনিধিরা ক্ষমতায় আসার পর অল্পদিনে শাসক শ্রেণীতে রূপান্তরের ফলে অতীতের শাসকদের শ্রেণীচরিত্র অর্জন করতে শুরু করেছে। এই বিপদ ও তার প্রতিকারের কথাতো কার্ল সার্কস তার কোনো কেতাবে লিখে যাননি।
মাও কালচারাল রেভ্যুলিউশনের পন্থা উদ্ভাবন করেন। এই রেভ্যুলিউশন কার্যকর করার ব্যাপারে তার পার্টিতে মতভেদ ছিলো।  কিন্তু তার স্ত্রী ও তিন ঘনিষ্ঠ অনুসারীর দ্বারা গঠিত ‘গ্যাঙ অব ফোর’ এই সাংস্কৃতিক বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয়। এই বিপ্লবের মূল কথা ছিলো, কম্যুনিস্ট-শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পরও সমাজ পরিবর্তনের ধারাতে সমাজের প্রত্যেকটি পর্যায়ে, প্রত্যেক পেশায় এমনকি সরকারের পরিচালকদের মধ্যেও যে এলিট শ্রেণীর উদ্ভব ঘটছে এবং পূর্বতন এলিট ও ক্ষমতাসীন শ্রেণীর অভ্যাস, চিন্তাধারা, জীবনযাত্রা ও আভিজাত্যবোধ ফিরে আসছে, তাকে অঙ্কুরেই গুঁড়িয়ে দেওয়া এবং ধনবাদী সমাজের পেশাগত বৈষম্য ও কায়েমী আভিজাত্যবোধ বিলুপ্ত করে সমাজতন্ত্রী সমাজ গড়ার ব্যবস্থাটি যাতে ধনবাদী বিচ্যুতির পথে না গড়ায় তার শেষ চেষ্টা করা।
বয়স এবং বার্ধক্যের জন্য মাও জে দুং তার এই শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করে যেতে পারেননি। তার পার্টির নতুন গজিয়ে ওঠা এলিট শ্রেণীর বাধাদানের ফলেই কালচারাল রেভ্যুলিউশন ব্যর্থ হয় এবং এই বিপ্লবকে এক বিমূর্ত চেহারায় দাঁড় করিয়ে সারা বিশ্বে তাকে নিন্দিত করে তোলা হয়। সেই সঙ্গে মাওকেও। কালচারাল রেভ্যুলিউশনকে পাগলামি, তোগলকি কাণ্ড, সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিদের অবমাননা ও নির্যাতন ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে মার্কিন ক্যাপিটালিস্ট এলিট ক্লাস ও মিডিয়া বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় সৃষ্টি করে। চীনের কম্যুনিস্ট এলিট ক্লাসের একটা অংশকেও মাওয়ের মৃত্যুর পর সেই ঝড়ে গা ভাসাতে দেখা গেছে। বাংলাদেশে অনেক পরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রবর্তিত বাকশাল পদ্ধতি সম্পর্কে পশ্চিমা জগতে এবং আমাদের নব্যধনী ও এলিট ক্লাসের কায়েমী স্বার্থভোগী অংশের মধ্যেও একই প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। এ সম্পর্কে যথাস্থানে আলোচনা করবো।
মাও জে দুংয়ের জীবিতকালেই কালচারাল রেভ্যুলিউশন ব্যর্থ করা হয়। তার মৃত্যুর আগেই লিন পিয়াওর পতন ঘটে। প্রচার করা হয়, তিনি দেশ থেকে পলায়নকালে বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। কিন্তু পশ্চিমা সূত্রই খবর প্রকাশ করে যে, তাকে বিমান দুর্ঘটনা ঘটিয়ে হত্যা করা হয়। মাওয়ের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী এবং গ্যাঙ অব ফোরের অন্য তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে কারাগারে বন্দি করা হয়। চীনে কম্যুনিস্ট পার্টি ও সরকারের পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং পুরনো শ্রেণী কাঠামোয় বিশ্বাসী তথাকথিত এলিট শ্রেণী ক্ষমতা দখল করে। আমেরিকা তাদের ‘Most favoured trade partner’ (সবচাইতে প্রিয় ব্যবসা-সঙ্গী) হিসেবে ঘোষণা করে দ্রুত ট্রেড পার্টনারশিপ মিলিটারি পার্টনারশি‘পে পরিণত হয়। এখন অবশ্য চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব স্বার্থ ও আধিপত্যের, আদর্শের নয়। মাওয়ের শেষ ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। মাওবাদ-বর্জিত মাওয়ের চীন নতুনভাবে গড়ে উঠেছে।
কেবল লেনিন ও মাওয়ের বেলাতে নয়, আমাদের উপমহাদেশের দিকে তাকালেও দেখা যাবে, আমাদের তিনজন প্রধান নেতার জীবনের শেষ ইচ্ছাই পূর্ণ হয়নি। শেষ জীবনে তাদেরও চিন্তা- চেতনায় রূপান্তর ঘটেছিল এবং তারা দেশকে নতুনভাবে গড়তে চেয়েছিলেন। তাদের ইচ্ছা সফল হয়নি। এরা হলেন, মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্না এবং শেখ মুজিবুর রহমান। গান্ধী ও জিন্নার শেষ জীবনের ইচ্ছা পূর্ণ না হওয়া নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, অনেক বই বেরিয়েছে। শেখ মুজিবের মৃত্যুপূর্ববর্তী শেষ জীবনের ইচ্ছা এবং তা পূর্ণ না হওয়া সম্পর্কে এখনো তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। কোনো বই বেরোয়নি। (শেষাংশ আগামী শুক্রবার)
লন্ডন, ৩০ জুন, শনিবার, ২০১২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন