আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
পদ্মা সেতু সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিকে একটি আশার বাণী শুনিয়েছেন। সংসদে তিনি বলেছেন, অভ্যন্তরীণ সম্পদ দ্বারাই পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত করা সম্ভব এবং তার সরকার এই কাজটি করবে। সংসদে দেওয়া বক্তৃতায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের চাতুরীর কথাও তিনি ব্যক্ত করেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। তিনি দেরিতে হলেও বিশ্বব্যাংকের খেলা সম্পর্কে সোজাসাফটা কথা বলেছেন এবং জাতিকে আশ্বাস দিয়েছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ দ্বারা পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব এবং এই সম্ভব কাজটিই তার সরকার করবে।
প্রধানমন্ত্রী এখন যে কথা বললেন, তার অর্থমন্ত্রী আগেই সে কথা বলতে পারলেন না কেন, তা আমার কাছে এক বিস্ময়। তিনি উল্টো বলেছিলেন, অভ্যন্তরীণভাবে অর্থ সংগ্রহ দ্বারা পদ্মা সেতু প্রকল্পের মতো কাজ করা সম্ভব নয়। সম্ভবত এই ধরনের নেতিবাচক মনোভাব থেকেই তিনি বিশ্বব্যাংকের সকল অযৌক্তিক ও অন্যায় দাবির সামনে নতজানু হয়ে দেনদরবার চালিয়ে যাওয়ার নীতি গ্রহণ করেছিলেন এবং সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীকে এমন কথা বুঝিয়েছিলেন যে, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক, তাতে ব্যাংকপ্রধানদের মন তিনি গলাতে পারবেন।
অর্থমন্ত্রী তা পারেননি। তথাপি আশা ছাড়েননি। সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন না করার একতরফা ও অবমাননাকর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়ার পরও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিশ্বব্যাংকের কাছে ধর্ণা দেওয়ার কাজটি চালিয়ে যেতে চাচ্ছেন। এটা টিপিক্যাল ব্যুরোক্রেটিক টেন্ডেন্সি (বিশেষ ধরনের আমলা মনোভাব)। আমি ব্যক্তিগতভাবে অর্থমন্ত্রীকে চিনি এবং শ্রদ্ধা করি। ছাত্রজীবনে তিনি বাম রাজনীতি করতেন এবং ভাষা আন্দোলনে আমরা এক সঙ্গে জেল খেটেছি। তিনি বিশ্বব্যাংকেও চাকরি করেছেন, কিন্তু বাংলাদেশের অনেকের মতো তাদের চাকর হননি জানতাম। আমি তার চরিত্রকে চলি্লশের দশকের কমরেড কবি গোলাম কুদ্দুসের কবিতা দিয়ে বিচার করতাম :
'চাকুরি করবো চাকর রবো না
লক্ষ গলায় গর্জন
আজ দৈত্য বধের সত্য করেছি অর্জন।'
বাংলাদেশের বর্তমান অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের মতো দৈত্য বধের শক্তি অর্জন না করুন, অন্তত এই দৈত্যের ছলচাতুরী ও চক্রান্ত থেকে জাতিকে মুক্ত রাখার সাহস দেখাবেন এটা আশা করেছিলাম। যে সাহসটা শেখ হাসিনার প্রথম অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া সাহেব দেখিয়েছিলেন।
যে প্রলয়ঙ্করী বন্যা ও প্লাবনকবলিত বাংলাদেশ দেখে বিবিসি থেকে শুরু করে অধিকাংশ বিদেশি পর্যবেক্ষক ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, এবার বাংলাদেশে প্লাবনজনিত দুর্ভিক্ষে কমপক্ষে দু'লাখ লোক মারা যাবে, সে দুর্ভিক্ষ তৎকালীন হাসিনা সরকার ঠেকিয়েছিল। একজন লোককেও না খেয়ে মারা যেতে দেওয়া হয়নি। ত্রাণকার্যে সারা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে নেমেছিল। বন্যাদুর্গতদের বাঁচানোর জন্য মার্কিন নৌ-সৈন্য ডেকে আনতে হয়নি। ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে ছুটতে হয়নি। এই অসম্ভবও সম্ভব করেছিল হাসিনা সরকার। অর্থমন্ত্রী হিসেবে কিবরিয়া সাহেবের অবদান তাতে ছিল অনন্য।
এখন পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করবে না জেনে বিএনপি-জামায়াত এবং একশ্রেণীর মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবী বগল বাজাচ্ছেন। ভাবছেন এই সরকারের পতন আর ঠেকায় কে? শেখ হাসিনার প্রথম মন্ত্রিসভার আমলে মহাপ্লাবন ও বন্যার পর দু'লাখ লোক না খেতে পেরে মারা যাবে বলে পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যদ্বাণী করায় বিএনপি ও তাদের সেবাদাসরা সেদিনও এমনি করে আনন্দে বগল বাজিয়েছিল। এক উজবুক বিএনপি নেতা তো বলেই ফেলেছিলেন, 'চুয়াত্তরের (১৯৭৪) দুর্ভিক্ষে লক্ষাধিক লোকের মৃত্যু যেমন মুজিব সরকারের পতন ঘটিয়েছিল, এবার প্লাবনজনিত দুর্ভিক্ষে লক্ষাধিক লোকের মৃত্যু হাসিনা সরকারের পতন ঘটাবে।' শকুনির অভিশাপে সেবার গরু মরেনি।
এবারেও (হাসিনার দ্বিতীয় দফা সরকারের আমলে) পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন না করার ঘোষণা দেওয়ায় একই মুখচেনা রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলে আনন্দের বিউগল বাজছে। তাদের কাছে পদ্মা সেতু না হলে সর্বনাশটা হাসিনার, দেশের নয়। হাসিনার সঙ্গে দেশেরও যদি সর্বনাশ হয় তাতে তাদের আপত্তি নেই। এরা কারা? এই তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকাটি তাদের 'লাইফ স্কেচ'সহ প্রকাশ করলে দেখা যাবে, অধুনা যারা ড. ইউনূসের মহত্ত্ব কীর্তন কোরাসে যোগ দিয়েছেন অথবা পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ হওয়ায় বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি উচ্চারণ না করে হাসিনা সরকারের মাথায় একতরফা সব দোষ চাপাতে ব্যস্ত, তারা অধিকাংশই বিশ্বব্যাংকের মোসাহেব। আমাদের বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে (আমার মুহিত ভাই) আমি বিশ্বব্যাংকের এই বাংলাদেশি সেবাদাসের দলে ফেলিনি। ছাত্রজীবনে বামপন্থি এবং এরশাদের অর্থমন্ত্রী পদে স্বেচ্ছায় ইস্তফাদানকারী এই মানুষটিকে আমি অন্য চোখে দেখতাম এবং এখনও দেখি। সে দেখা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার দেখা। দেশের শেয়ারবাজার ধস নিয়ন্ত্রণে তিনি যে দ্রুত সক্ষম হতে পারেননি বা পারছেন না, তাতেও আমি তাকে ব্যর্থ অর্থমন্ত্রী বলি না বা তিনি পদত্যাগ করুন তা চাই না। কারণ, এই শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি উদ্দেশ্যমূলকভাবে মনুষ্যসৃষ্ট এবং অর্থমন্ত্রী কোন অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে অসম যুদ্ধে ঠেকে গেছেন তা আমি জানি। কিন্তু মন্ত্রী ও ব্যক্তি হিসেবে তার দুর্বলতা আমি প্রথম টের পাই ড. ইউনূসের হাসিনা সরকারবিরোধী তৎপরতা মোকাবেলা করার সময়।
তিনি ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত বন্ধু। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি এবং ড. ইউনূস দু'জনেই আমেরিকায় ছিলেন। কিছুকাল আগে একদিন ঢাকায় প্রায় মধ্যরাতে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কয়েকজন বন্ধুসহ গল্প-গুজব করছি, তখন তিনি ড. ইউনূসের তখনকার কিছু কাণ্ডকীর্তির কথা বলছিলেন। আমি তখনই তাকে বলেছিলাম, আপনি ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা ভেবে তার প্রতি দুর্বলতা দেখাবেন না। তার প্রতি অযথা অবিচার না হয় তা আপনি দেখবেন; কিন্তু তার কার্যকলাপে যদি দেশের ক্ষতি, দেশের গরিব মানুষের ক্ষতি হয়, তাহলে আপনাকে অবশ্যই শক্ত হতে হবে। আপনি জানেন, কেন তাকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ী হিসেবে ড. ইউনূস চতুর, কিন্তু ব্যক্তি-মানুষ হিসেবে ভীরু। তার রাজনৈতিক দল গঠনের সময়ই এই ভীরু চরিত্রের পরিচয় আপনি পেয়েছেন।
অর্থমন্ত্রীকে এও বলেছি, আপনি জানেন, শেখ হাসিনা অবশ্যই ড. ইউনূসের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভয়ে ভীতি নন। সেই সাহসের পরিচয় তিনি ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময়েই দেখিয়েছেন। তাদের বিরোধ নীতিগত। একজন সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর যাবৎ গ্রামীণ ব্যাংকে যে অনিয়ম চলছে, গরিব গ্রামীণ নারীদের মালিকানার নামে এক ব্যক্তির যে স্বেচ্ছাচারী মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার দিকে নজর না দিয়ে পারেন না। দেশের অর্থনীতিতে (এবং রাজনীতিতেও) বিদেশি স্বার্থের প্রতিভূ হিসেবে এক ব্যক্তির মনোপলি প্রতিষ্ঠিত হোক তাও তিনি চাইতে পারেন না। এ ব্যাপারে গোড়া থেকেই আপনার সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।
সত্য কথা বলতে কি, অর্থমন্ত্রী হিসেবে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে তার যোগাযোগ থাকা সত্ত্বেও মুহিত ভাই গোড়াতে ড. ইউনূস সম্পর্কে নিজের দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। শক্ত হতে পারেননি। গ্রামীণ ব্যাংক প্রধানের পদ থেকে ড. ইউনূসকে অব্যাহতি দেওয়া উচ্চ আদালত বৈধ বলে রায় দেওয়ার পরও তিনি তাকে ব্যাংকটির ক্ষমতাহীন সুপ্রিমো করে রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তখন ড. ইউনূস সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এক কথা এবং অর্থমন্ত্রী বলেছেন আরেক কথা। যেমন নিজেদের অভ্যন্তরীণ সম্পদ দ্বারা পদ্মা সেতু প্রকল্পের বাস্তবায়ন সম্ভব কি-না সে সম্পর্কে এখন আবার প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে পরস্পর বিরোধিতা দেখা যায়।
ড. ইউনূস সম্পর্কেও গোড়ায় অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য দেশের মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। সেই বিভ্রান্তির সুযোগ নিয়ে একশ্রেণীর সুযোগসন্ধানী মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবী ড. ইউনূসের 'মহামিত্র' সেজে সরকারবিরোধী প্রচার যুদ্ধে নেমে পড়েছে। কারণ, তারা বুঝতে পেরেছিল, এই যুদ্ধে বিশ্বের একক সুপার পাওয়ার ও পশ্চিমা দেশগুলো কোন পক্ষে? ড. ইউনূসের পেছনে শক্তি জোগাচ্ছে কারা?
অর্থমন্ত্রী তখনও বুঝিয়ে-সুজিয়ে বন্ধু ড. ইউনূসকে ঠাণ্ডা করতে পারবেন ভেবেছিলেন। তিনি তা পারেননি। বরং তার নমনীয় মনোভাবকে সরকারের দুর্বলতা ভেবে নিয়ে অপর পক্ষ আরও বেশি রণবাদ্য এখন পেটাতে শুরু করেছে। অর্থমন্ত্রীর এখন চৈতন্য ফিরেছে। তিনি এখন বলতে বাধ্য হয়েছেন, 'ড. ইউনূস যা বলেছেন তা রাবিশ।' কিন্তু তার এই রাবিশ শব্দটি আর অস্ত্র হিসেবে কাজ করবে কিনা তা সন্দেহের বিষয়।
পদ্মা সেতু নিয়েও আমাদের অর্থমন্ত্রী বা সরকার বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবেন তা বলি না। বাংলাদেশ ছোট এবং গরিব দেশ। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এদের সঙ্গে লড়াই করার তো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু একটি ছোট এবং দুর্বল দেশও আত্মপ্রত্যয়ী ও সাহসী হলে শক্তিধরদের অন্যায় চাপ প্রতিহত করতে পারে, সাম্প্রতিক বিশ্বে তার প্রমাণ আছে।
অতীতে প্রেসিডেন্ট নাসেরের আমলে আমেরিকা হঠাৎ অর্থায়ন বন্ধ করা সত্ত্বেও মিসরের আসোয়ান বাঁধ তৈরি হয়েছিল। অবশ্য তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল, তারা সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু চীনের 'চিরকালের দুঃখ' নামে পরিচিত হোয়াংহো নদীর প্লাবন রোধ ও বাঁধ নির্মাণে পশ্চিমা অর্থ সাহায্য ছাড়াই শুধু জনবলের সাহায্যে যে অসম্ভবকে সম্ভব করা হয়েছে তা বিস্ময়কর।
বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধে ফরাসি ও আমেরিকানরা ভিয়েতনামকে একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছিল। তার পুনর্গঠনের অর্থের প্রয়োজন ছিল পঞ্চাশটা পদ্মা সেতু তৈরির অর্থেরও বেশি। বিশ্বব্যাংক টাকা দেয়নি, আমেরিকা ও পশ্চিমা দাতা দেশ টাকা দেয়নি। হো চি মিন সরকার অভ্যন্তরীণ সম্পদ ও জনবল ব্যবহার করে আজকের শক্তিশালী ভিয়েতনাম গড়ে তুলেছেন। বাংলাদেশে একটি পদ্মা সেতু কেন অভ্যন্তরীণ সম্পদ ও আমাদের বিশাল জনবল দ্বারা হাসিনা সরকার তৈরি করতে পারবে না? চাই সরকারের দৃঢ় মনোবল এবং একজন অর্থমন্ত্রীর সাহস ও কৌশল। আমাদের অর্থমন্ত্রী এই দুটি গুণ অর্জন করুন, এটি আমার প্রার্থনা।
লন্ডন, ৬ জুলাই ২০১২, শুক্রবার