আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
সম্প্রতি কলকাতায় সাবেক পুলিশ কমিশনার এবং পরবর্তী জীবনে নৃতত্ত্ব ও কৃষি গবেষণার জন্য বিখ্যাত একজন পণ্ডিত রণজিত গুপ্ত প্রয়াত হয়েছেন। তিনি কেবল পশ্চিমবঙ্গের নকশাল যুগের একজন দাপুটে পুলিশকর্তা হলে সম্ভবত তার মৃত্যুতে পত্রপত্রিকায় এত অবিচুয়ারি প্রকাশিত হতো না। ইন্দিরা যুগে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুলিশকর্তা হিসেবে তার নাম সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়লেও তার বিশেষ খ্যাতি নৃতত্ত্ব ও কৃষি অর্থনীতি সম্পর্কিত গবেষণায়। চাকরি জীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর প্রায় ৩০ বছর তিনি এই গবেষণায় ও হাতে-কলমের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। এ জন্য নিউইয়র্ক টাইমস তাকে 'ংবষভ ঃধঁমযঃ ধমৎধৎরধহ বীঢ়বৎঃ ধহফ ধহঃযৎড়ঢ়ড়ষড়মরংঃ' (স্বশিক্ষিত কৃষি বিশেষজ্ঞ ও নৃতত্ত্ববিদ) আখ্যা দিয়েছিল।
রণজিত গুপ্তের জন্ম বাংলাদেশে। পরে তারা পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। তার ভাই অশোক গুপ্তের নামের সঙ্গেও আমরা পরিচিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অশোক গুপ্ত ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসে একজন কূটনৈতিক কর্মকর্তা ছিলেন। সেটা বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমল। সুবিমল দত্ত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের প্রথম হাইকমিশনার। অশোক গুপ্ত ছিলেন সম্ভবত প্রেস কাউন্সিলর। তিনি সাহিত্য চর্চাও করেন। 'বিক্রমাদিত্য' এই ছদ্মনামে লেখা তার কিছু বইও বাজারে আছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অশোক গুপ্তকে সামরিক সরকার ৭২ ঘণ্টার নোটিশে ঢাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য করে। তিনি পরে বঙ্গবন্ধু হত্যা সম্পর্কে 'মিডনাইট ম্যাসাকার' নামে একটি বইও লিখেছেন।
অশোক গুপ্তের চেয়ে তার ভাই রণজিত গুপ্তের পরিচিতি অনেক বেশি। পরে কৃষি অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ এবং নৃতাত্তি্বক হিসেবে খ্যাতি লাভ করলেও পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে তিনি খ্যাতি লাভ করেন নকশাল সন্ত্রাস দমনে। দিলি্লতে তখন ইন্দিরা সরকার ক্ষমতায়। পশ্চিমবঙ্গেও কংগ্রেসী আমল। চারু মজুমদারের সন্ত্রাসী নকশাল আন্দোলন তখন পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম-গঞ্জে, এমনকি বিহার, উড়িষ্যা এবং ত্রিপুরাতেও ছড়িয়ে পড়ছে। কলকাতায় রাজপথে প্রকাশ্য দিনের বেলায় পুলিশ, মিলিশিয়ার সঙ্গে যখন-তখন নকশালদের সশস্ত্র যুদ্ধ চলে। বর্তমানের মাওবাদী সন্ত্রাসের মতো তখন নকশালী সন্ত্রাস অনেকের কাছে অদম্য ও অপ্রতিরোধ্য মনে হয়েছিল।
এ সময় এই নকশাল সন্ত্রাস দমনের পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নে রণজিত গুপ্তের ডাক পড়ে। তিনি নকশাল দমনের জন্য একটি রূপরেখা প্রণয়ন করেন এবং পুলিশ বাহিনী সম্পূর্ণ ঢেলে সাজান। তখন নকশালি হামলায় প্রায়ই পুলিশ নিহত হতো। তিনি এই পুলিশদের জীবন রক্ষার জন্য নিজে যে পরিকল্পনা তৈরি করেন, তাতে অনেক পুলিশের জীবন রক্ষা পায়। তার নাম ভারতের সর্বত্র পরিচিত হয়ে ওঠে।
রণজিত গুপ্ত পুলিশের অধিকর্তা হিসেবে চাকরি করেছেন ৩৫ বছর। পরে অবসর নিয়ে ৩০ বছর তিনি কাটিয়েছেন কৃষি ও নৃতত্ত্ব বিষয়ক গবেষণায়। সক্রিয় ছিলেন গ্রামীণ উন্নয়ন বিষয়ক কাজকর্মে। এ সময়ই ক্ষুদ্রঋণ ও গ্রামীণ ব্যাংক ব্যবস্থার কথা তার মাথায় ঢোকে। তিনি এই ব্যবস্থা সম্পর্কে গবেষণা শুরু করেন এবং 'অমৎধৎরধহ ডবংঃ ইবহমধষ ঃযৎবব ভরবষফ ংঃঁফরবং' নামে একটি বই লেখেন। এই বইতেই তিনি প্রথম গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার আভাস তুলে ধরেন।
রণজিত গুপ্তের মৃত্যুর পর সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার গ্রাম-ভাবনা সম্পর্কে অনেক নিবন্ধ, স্মৃতিকথা প্রকাশিত হচ্ছে। তার একটি লেখা লিখেছেন রণজিত গুপ্তের সহকর্মী এবং ক্রেডিট ওয়াচ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক ড. প্রদীপ হর। তিনি কলকাতার 'দৈনিক স্টেটসম্যান' পত্রিকায় (২৪ মে বৃহস্পতিবার, ২০১২) 'রণজিত গুপ্তের বর্ণময় জীবন' শীর্ষক আলোচনায় গ্রামীণ ব্যাংক ব্যবস্থা সম্পর্কিত রণজিত গুপ্তের রূপকল্পের বিবরণ তুলে ধরেছেন। নিচে তার লেখা থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি।
ড. প্রদীপ হর লিখেছেন, '... সেই সময়কার গ্রামাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নকশালদের মতোই তিনিও বিশ্বাস করতেন গ্রামের বড় ভূস্বামী ও জোতদারদের ক্ষমতা হ্রাসের প্রয়োজনীয়তার কথা। ছোট চাষি এবং বর্গাদারদের নিয়ে ৫০০ থেকে ১০০০ একর জমি নিয়ে সমবায়ভিত্তিক ক্লাস্টার এবং সেখানে গভীর নলকূপ বসিয়ে সেচ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। সে সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে ছোট চাষি ও গরিব পরিবারকে ঋণ জোগান দেওয়ার কথা বলেছিলেন। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর আরও ৩০ বছর তিনি গ্রামীণ উন্নয়ন বিষয়ক কাজকর্ম চালিয়ে গেছেন।
রণজিত গুপ্তের আরেক বন্ধু ও সহকর্মী লিখেছেন, "গ্রামের ছোট চাষিদের উন্নয়ন এবং গরিব পরিবারগুলোকে ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে উৎপাদনশীল কাজে জড়িত করার জন্য তিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছিলেন, নাম দিতে চেয়েছিলেন 'পুওর পিপলস ব্যাংক'। তাতে সরকারের অনুদান থাকবে, কিন্তু যাচাই-বাছাই ছাড়া কোনো বিদেশি ঋণ বা সাহায্য নয়। রণজিত গুপ্ত ভয় করতেন, বিদেশি সাহায্য ও অনুদানের সঙ্গে যে অদৃশ্য তদারকি ও কর্তৃত্বের শিকলটি এই ধরনের ব্যাংক বা সংস্থার গলায় জড়াবে, তা থেকে মুক্ত হওয়া কোনো সময় সম্ভব হবে না; বরং গরিব ঋণগ্রহীতার ঘাড়ে ঋণের বোঝা আরও বাড়বে। তাদের দারিদ্র্য বাড়বে। এ জন্য তিনি সমবায়মূলক ব্যবস্থার ও অভ্যন্তরীণভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের মূলধন সংগ্রহ এবং বিনাসুদে অথবা অল্প সুদে ঋণদানের ব্যবস্থা করা যায় কি-না, সে কথাও চিন্তা-ভাবনা করেছেন।"
রণজিত গুপ্তের পরিকল্পনায় গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা থাকবে গরিব শেয়ারহোল্ডারদের হাতে। তাদের নির্বাচিত বোর্ড ব্যাংক পরিচালনা করবে এবং এই ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে কোনো এক ব্যক্তির কর্তৃত্বের বদলে সরকারের নজরদারি থাকবে। ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররা ব্যাংকের কার্যক্রম ও হিসাব সম্পর্কে অবহিত থাকবেন এবং মুনাফার অংশ পাবেন। 'এই ব্যাংকের কোনো মালিক নেই। মালিকদের শতকরা ৮০ ভাগ নিরক্ষর নারী'_ এই ধরনের চটকদার কথা রণজিত গুপ্ত শোনাননি। নিরক্ষর মহিলারা কেন, নিরক্ষর পুরুষরাও দক্ষতার সঙ্গে ব্যাংক পরিচালনা করতে পারে বা করে এটা শুধু শুভঙ্করের বিরাট ফাঁকি নয়, এ শতকের সবচেয়ে বড় ভাঁওতাও।
নিরক্ষর কিছু নারী ও পুরুষ জুটিয়ে, কোনো ব্যাংক বা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানার প্রলোভন ওদের দেখিয়ে নিজের একক কর্তৃত্বে তা পরিচালনা করা এবং প্রতিষ্ঠানটির সকল সুযোগ-সুবিধা লোটার উদাহরণ গত শতকের ইউরোপেও আছে। সেসব ইতিহাস লিখতে গেলে এই লেখার কলেবর বড় হয়ে যাবে। বারান্তরে সে ইতিহাস লেখা যাবে।
রণজিত গুপ্ত সম্পর্কে তার সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠজনের স্মৃতিচারণা পড়ে মনে হয়, 'নকশাল আন্দোলন দমন করতে গিয়ে তিনি নকশালদের কিছু চিন্তা-ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তার মধ্যে ছোট চাষিদের ভাগ্যোন্নয়ন এবং ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থা করার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা একটি। তিনি পশ্চিমবঙ্গে নকশাল দমনের দায়িত্বে থাকাকালে সরকারের কাছে রিপোর্ট করেছিলেন যে, কেবল সশস্ত্র পন্থায় দমননীতি প্রয়োগ করে নকশাল সমস্যা স্থায়ীভাবে দূর করা যাবে না। পাশাপাশি গ্রামের মানুষের দারিদ্র্য দূর করার জন্য কার্যকর আর্থিক ও সামাজিক কার্যক্রম শুরু করা দরকার। গরিব মানুষের দারিদ্র্য দূর করা ও কর্মসংস্থানের জন্য নকশাল আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রামের জনসাধারণ ও বেকার যুবকদের কাছে এক বিরাট আবেদন সৃষ্টি করেছে। এর চেয়ে উন্নত আবেদন গ্রামের মানুষের কাছে তুলে ধরা দরকার।'
সরকারকে এ কাজে এগোতে না দেখে একজন ব্যক্তি মানুষ হয়েও রণজিত গুপ্ত চাকরি থেকে অবসর নিয়ে নিজেই গরিব মানুষের অভাব দূর করা এবং তাদের ভাগ্যোন্নয়নের পরিকল্পনা তৈরি ও তা বাস্তবায়নের কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। চারদিকে ব্যাপক ও বিরাট পুঁজিবাদী ব্যবস্থার রাহুগ্রাসের মধ্যে অপুঁজিবাদী ব্যবস্থায় একক উদ্যোগে দারিদ্র্য দূর করার আন্দোলন পরিচালনা কতটা অসম্ভব, রণজিত গুপ্ত তা নিজেও বোঝেননি তা নয়, কিন্তু তিনি আমৃত্যু তার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
বর্তমানে পুঁজিবাদী শক্তির একক আধিপত্যের যুগে একটা বিষয় লক্ষণীয়। যখনই জনকল্যাণকর অপুঁজিবাদী কোনো ব্যবস্থা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, পুঁজিবাদ সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধারণ করে নিজের স্বার্থ রক্ষার কাজে লাগায়। ১৯৫৮ সালে আমরা দেখেছি, পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করার জন্য মৌলিক গণতন্ত্র (নধংরপ ফবসড়পৎধপু) নাম দিয়ে আরও আকর্ষণীয় নামের একটি ব্যবস্থা প্রবর্তনের চেষ্টা হয়েছিল। তাও আবার হয়েছিল আইয়ুবের মতো সামরিক শাসকদের দ্বারা।
দেশের সকল মানুষের ভোটাধিকার হরণ করে, তখনকার পাকিস্তানের দুই অংশে ৪০ হাজার করে 'মৌলিক গণতন্ত্রী' সৃষ্টি করে তাদের হাতে ভোটাধিকার সীমাবদ্ধ রেখে বলা হয়েছিল, এটাই আসল বা মৌলিক গণতন্ত্র। এই মৌলিক গণতন্ত্রীদের নানা সুযোগ-সুবিধা, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অঢেল টাকা গছিয়ে দিয়ে তাদের সকলকেই ক্ষমতাসীনদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছিল। কর্তাদের হুকুমের বাইরে তাদের নড়াচড়ারও উপায় ছিল না। বিচারপতি কায়ানি তাই বিদ্রূপ করে বলেছিলেন, 'নধংরপ ফবসড়পৎধপু_ হবরঃযবৎ নধংরপ, হড়ৎ ফবসড়পৎধপু' (মৌলিক গণতন্ত্র মৌলিক নয়, গণতন্ত্রও নয়)।
বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংক ব্যবস্থা সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। ওঃ রং হবরঃযবৎ ৎঁৎধষ, হড়ৎ ধ নধহশ, এটা গ্রামীণ নয়, ব্যাংকও নয়। এর আদি উদ্ভাবকরা যে মহৎ উদ্দেশ্যে ক্ষুদ্রঋণ, গ্রামীণ ব্যাংক বা গরিবের ব্যাংক ইত্যাদি পরিকল্পনার কথা ভেবেছিলেন, তা গ্গ্নোবাল ক্যাপিটালিজমের হাতে হাইজ্যাক হয়ে গেছে বহু আগে। এখন নিজেদের বাছাই করা একদল নিরক্ষর মহিলাকে ব্যাংকের মালিক হওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে, মুনাফার অংশ পাওয়ার অধিকারবিহীন শেয়ার গছিয়ে দিয়ে ব্যক্তিবিশেষের অঘোষিত মালিকানার কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে, পুঁজিবাদী বিশ্বেও তার তুলনা বিরল। চড়া সুদে দেওয়া এই ক্ষুদ্রঋণের শোষণ ও লুণ্ঠনের প্রক্রিয়াটি বড় নির্মম।
এই ব্যক্তি-স্বেচ্ছাচারিতারই নাম দেওয়া হয়েছে গরিবের মালিকানা। দেশের সরকারও এ ব্যাপারে কোনো অনিয়ম হচ্ছে কি-না তা দেখতে চাইলে চিৎকার শুরু হয় গরিবের মালিকানা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। বেচারা গরিবরা জানে না তাদের মালিকানার চেহারাটা কী? তারা হুকুম পালনে অভ্যস্ত।
পশ্চিমবঙ্গে রণজিত গুপ্তের গ্রামীণ ব্যাংক বা গরিবের ব্যাংকের রূপরেখা যে বাংলাদেশের চেয়ে আলাদা, তা তার এই ঋণদান সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো পড়লেই বোঝা যায়। গরিবের নামে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে তিনি নিজে সওদাগিরি করতে চাননি। পশ্চিমবঙ্গে ৩০ বছরের কমিউনিস্ট জমানাতেই যখন তার পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হয়নি, তখন ভবিষ্যতে হবে কি-না সন্দেহ। হলে ভালো হতো। বাংলাদেশের মানুষের চোখ খুলত।
লন্ডন, ১৫ জুন ২০১২, শুক্রবার
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন