শনিবার, ৩০ জুন, ২০১২

পাঁচ নেতার শেষ জীবনের অপূর্ণ ইচ্ছা ও পরিকল্পনা



 আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী 
বেশ কিছুকাল আগে এক বন্ধু আমাকে একটি বই উপহার দিয়েছিলেন। বইটির নাম “লাস্ট ডেজ অব লেনিন” (লেনিনের শেষের দিনগুলো)। নানা কারণে বইটি তখন পড়া হয়নি। সম্প্রতি এক অবকাশ মুহূর্তে বইটি পড়া শুরু করে আর শেষ না করে পারিনি। বইটিতে লেনিনের শেষ জীবনের এমন অনেক ইচ্ছার কথা প্রকাশ করা হয়েছে, যা আগে জানতে পারিনি। আর এখনতো জানার উপায়ই নেই। সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের ব্যান্ড-বাদকেরা এমন একতরফাভাবে লেনিন, স্ট্যালিন, মাও প্রমুখ বিশ্ব কম্যুনিস্ট নেতার চরিত্র হনন শুরু করেছেন যে, এখন তাদের সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্যই জানা মুশকিল।
‘লাস্ট ডেজ অব লেনিন’ বইটি পশ্চিমা ধনবাদী শিবিরের বর্তমান প্রোপাগান্ডা শুরু করার আগের লেখা। ফলে লেনিনের শেষ জীবনের ইচ্ছা ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে এমন কিছু তথ্যভিত্তিক বিবরণ পাওয়া যায়, যা কেউ চ্যালেঞ্জ করেননি। একটি সোস্যালিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠার পরই লেনিন বুঝতে পেরেছিলেন, কঠোর তত্ত্বভিত্তিক প্লোরেতারিয়েত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। প্লোরেতারিয়েতরা (সর্বহারা) চিরকাল প্লোয়েতারিয়েত বা সর্বহারা থাকে না। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পর তারাও শাসক শ্রেণীতে পরিণত হয় এবং তাদেরও চরিত্র বদল হয়।
এই চরিত্র বদলের ফলে তারাও যাতে আগের ধনবাদী শাসকদের চরিত্র বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন না করে, সেজন্য তিনি কঠোর সমাজতান্ত্রিক একদলীয় ব্যবস্থার মধ্যেও হিউম্যানিজমের কিছু কিছু জানালা খুলে দিতে চেয়েছিলেন। হিউম্যানিজমের বৈশিষ্ট্যবর্জিত কম্যুনিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা দানব-চেহারা ধারণ করতে পারে এটা গোড়াতেই উপলব্ধি করে লেনিনের ভারতীয় সহকর্মী এম.এন রায় কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে ভারতে এসে মেডিক্যাল হিউম্যানিস্ট পার্টি গঠন করেছিলেন।
লেনিনের মৃত্যু-পূর্ববর্তী চিন্তাচেতনায় যে পরিবর্তন এসেছিলো, তা তিনি বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ক্রমে ক্রমে তিনি অবশ হয়ে পড়েন, তার বাকশক্তিও হ্রাস পায়। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় অনেক সময় ইঙ্গিতে অথবা কাউকে ডিকটেশন দিয়ে তার নির্দেশগুলো দিতেন। লেনিনের অসুস্থতার সময় তার দুই ঘনিষ্ঠ সহকর্মী স্ট্যালিন ও ট্রটস্কির মধ্যে গুরুতর মতবিরোধ দেখা দেয়। স্ট্যালিনই পলিটবু্যুরোতে অধিক ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন।
‘লাস্ট ডেজ অব লেনিন’ বইতে লেখা হয়েছে, লেনিন মৃত্যুর আগে যা চেয়েছিলেন, তা যদি বাস্তবায়িত হতো, তাহলে সোভিয়েট ইউনিয়ন একটি স্টেট ক্যাপিটালিজম ভিত্তিক কঠোর একনায়কত্ববাদী রাষ্ট্র হওয়ার বদলে ধীরে ধীরে এক ধরনের প্লুরালিস্টিক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে এগুতো এবং তার হিউম্যান ফেস বা মানসিক চেহারা হারাতো না।
কিন্তু স্ট্যালিন পরে লেনিনের অসুস্থতার সুযোগে এতো বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন যে, তিনি লেনিনের নির্দেশের পরোয়া করতেন না। তিনি পার্টি ও সরকারের অন্যান্য সদস্যের কাছে লেনিনের নির্দেশগুলো গোপন করে নিজের ইচ্ছাকেই লেনিনের নির্দেশ বলে চালাতেন। বাকশক্তি রহিত লেনিন মৃত্যুশয্যায় শুয়ে স্ট্যালিনের সব কার্যকলাপ লক্ষ্য করতেন। কিন্তু স্ট্যালিনের অনুচরদের দ্বারা সর্বসময় পরিবেষ্টিত অবস্থায় তার কিছুই করার ছিলো না। তিনি স্ট্যালিনের কার্যকলাপে বাধাদানের উপায় খুঁজেছেন। কিন্তু উপায় খুঁজে পাননি।
এই বইটি পাঠের পর কম্যুনিস্ট চীনের নেতা ও প্রতিষ্ঠাতা মাও জে দুংয়ের শেষ জীবনের ইচ্ছা-অনিচ্ছাগুলো জানারও আমার ইচ্ছে হয়। শুনেছি এ সম্পর্কে কয়েকটি বই বেরিয়েছে, কিন্তু আমি সংগ্রহ করতে পারিনি। মাও জে দুংয়ের জীবিতকালে লন্ডনের ‘দি ইকোনোমিস্ট’ পত্রিকা মাও জে দুংকে নিয়ে একটি দীর্ঘ কভার স্টোরি প্রকাশ করে, সেটি এবং পরবর্তীকালে চীন-বিশেষজ্ঞ কয়েকজন মার্কিন সাংবাদিকের লেখা পড়ার সুযোগ আমার হয়েছিলো। এগুলো পাঠ করে আমার মনে হয়েছে, মাও তার শেষ জীবনের ইচ্ছা পূর্ণ করে যেতে পারেননি। চীনে তার পরবর্তী কম্যুনিস্ট নেতারা মাওকে গ্রহণ করেছে, কিন্তু মাওবাদকে বর্জন করেছে।
 ‘দি ইকোনমিস্টের’ মাও সংক্রান্ত কভার স্টোরিতে চীনের কম্যুনিস্ট সরকার ও কম্যুনিস্ট পার্টিতে মাও বিরোধীদের সাথে মাওবাদীদের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের আভাস দেওয়া হয়েছিল। মাও তখনো জীবিত আছেন। তার অভিনেত্রী স্ত্রীকে ঘিরে তখনকার ‘গ্যাঙ অব ফোর’ (চারের চক্র) গড়ে ওঠে। মাওয়ের বিশ্বস্ত সহচর লিন পিয়াও খুবই শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, মাওয়ের পর লিন পিয়াও হবেন তার ক্ষমতার উত্তরাধিকারী। ‘দি ইকোনমিস্ট’ এই সম্ভাবনাকে সামনে রেখে তাদের কভার স্টোরির শিরোনামটি কভারেই বড় করে ছেপেছিলো। মুসলমানদের কলেমা তৈয়বের অনুকরণে তাতে নেয়া হয়েছিল ‘There is no Mao but Mao and lin piao is his prophet’ (মাও নেই, কিন্তু মাও আছেন এবং লিন পিয়াও তার পয়গম্বর)।
লেনিনের মতো মাও জে দুংও সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন একদলীয় দানব ব্যবস্থা দ্বারা সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রও টিকিয়ে রাখা যাবে না। এই চিন্তা থেকেই তিনি ‘let hundred flowers blossom বা শত ফুল ফুটতে দাও শীর্ষক তত্ত্বে সমাজতন্ত্রী সমাজে ভিন্ন মতের অবস্থানকেও মেনে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, চীনের নতুন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা এখনো মজবুত হয়নি এবং এই ব্যবস্থায় দুর্বলতার ফাঁকে ‘শত ফুল ফুটতে দাও’ থিয়োরির সুযোগ নিয়ে অধিক শক্তিশালী-ধনবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত কম্যুনিস্ট চীনকে ধ্বংস করতে পারে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে থিয়োরিটির বাস্তবায়ন বন্ধ করেন।
কিন্তু শেষ জীবনে মাও জে দুং আরেকটি সত্য অনুধাবন করেন।  যে কৃষক ও শ্রমিক এবং নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীকে সংঘবদ্ধ করে তিনি চীনে কম্যুনিস্ট বিপ্লব সফল করেছেন, সেই কৃষক-শ্রমিক শ্রেণী বা তাদের  প্রতিনিধিরা ক্ষমতায় আসার পর অল্পদিনে শাসক শ্রেণীতে রূপান্তরের ফলে অতীতের শাসকদের শ্রেণীচরিত্র অর্জন করতে শুরু করেছে। এই বিপদ ও তার প্রতিকারের কথাতো কার্ল সার্কস তার কোনো কেতাবে লিখে যাননি।
মাও কালচারাল রেভ্যুলিউশনের পন্থা উদ্ভাবন করেন। এই রেভ্যুলিউশন কার্যকর করার ব্যাপারে তার পার্টিতে মতভেদ ছিলো।  কিন্তু তার স্ত্রী ও তিন ঘনিষ্ঠ অনুসারীর দ্বারা গঠিত ‘গ্যাঙ অব ফোর’ এই সাংস্কৃতিক বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয়। এই বিপ্লবের মূল কথা ছিলো, কম্যুনিস্ট-শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পরও সমাজ পরিবর্তনের ধারাতে সমাজের প্রত্যেকটি পর্যায়ে, প্রত্যেক পেশায় এমনকি সরকারের পরিচালকদের মধ্যেও যে এলিট শ্রেণীর উদ্ভব ঘটছে এবং পূর্বতন এলিট ও ক্ষমতাসীন শ্রেণীর অভ্যাস, চিন্তাধারা, জীবনযাত্রা ও আভিজাত্যবোধ ফিরে আসছে, তাকে অঙ্কুরেই গুঁড়িয়ে দেওয়া এবং ধনবাদী সমাজের পেশাগত বৈষম্য ও কায়েমী আভিজাত্যবোধ বিলুপ্ত করে সমাজতন্ত্রী সমাজ গড়ার ব্যবস্থাটি যাতে ধনবাদী বিচ্যুতির পথে না গড়ায় তার শেষ চেষ্টা করা।
বয়স এবং বার্ধক্যের জন্য মাও জে দুং তার এই শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করে যেতে পারেননি। তার পার্টির নতুন গজিয়ে ওঠা এলিট শ্রেণীর বাধাদানের ফলেই কালচারাল রেভ্যুলিউশন ব্যর্থ হয় এবং এই বিপ্লবকে এক বিমূর্ত চেহারায় দাঁড় করিয়ে সারা বিশ্বে তাকে নিন্দিত করে তোলা হয়। সেই সঙ্গে মাওকেও। কালচারাল রেভ্যুলিউশনকে পাগলামি, তোগলকি কাণ্ড, সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিদের অবমাননা ও নির্যাতন ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে মার্কিন ক্যাপিটালিস্ট এলিট ক্লাস ও মিডিয়া বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় সৃষ্টি করে। চীনের কম্যুনিস্ট এলিট ক্লাসের একটা অংশকেও মাওয়ের মৃত্যুর পর সেই ঝড়ে গা ভাসাতে দেখা গেছে। বাংলাদেশে অনেক পরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রবর্তিত বাকশাল পদ্ধতি সম্পর্কে পশ্চিমা জগতে এবং আমাদের নব্যধনী ও এলিট ক্লাসের কায়েমী স্বার্থভোগী অংশের মধ্যেও একই প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। এ সম্পর্কে যথাস্থানে আলোচনা করবো।
মাও জে দুংয়ের জীবিতকালেই কালচারাল রেভ্যুলিউশন ব্যর্থ করা হয়। তার মৃত্যুর আগেই লিন পিয়াওর পতন ঘটে। প্রচার করা হয়, তিনি দেশ থেকে পলায়নকালে বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। কিন্তু পশ্চিমা সূত্রই খবর প্রকাশ করে যে, তাকে বিমান দুর্ঘটনা ঘটিয়ে হত্যা করা হয়। মাওয়ের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী এবং গ্যাঙ অব ফোরের অন্য তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে কারাগারে বন্দি করা হয়। চীনে কম্যুনিস্ট পার্টি ও সরকারের পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং পুরনো শ্রেণী কাঠামোয় বিশ্বাসী তথাকথিত এলিট শ্রেণী ক্ষমতা দখল করে। আমেরিকা তাদের ‘Most favoured trade partner’ (সবচাইতে প্রিয় ব্যবসা-সঙ্গী) হিসেবে ঘোষণা করে দ্রুত ট্রেড পার্টনারশিপ মিলিটারি পার্টনারশি‘পে পরিণত হয়। এখন অবশ্য চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব স্বার্থ ও আধিপত্যের, আদর্শের নয়। মাওয়ের শেষ ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। মাওবাদ-বর্জিত মাওয়ের চীন নতুনভাবে গড়ে উঠেছে।
কেবল লেনিন ও মাওয়ের বেলাতে নয়, আমাদের উপমহাদেশের দিকে তাকালেও দেখা যাবে, আমাদের তিনজন প্রধান নেতার জীবনের শেষ ইচ্ছাই পূর্ণ হয়নি। শেষ জীবনে তাদেরও চিন্তা- চেতনায় রূপান্তর ঘটেছিল এবং তারা দেশকে নতুনভাবে গড়তে চেয়েছিলেন। তাদের ইচ্ছা সফল হয়নি। এরা হলেন, মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্না এবং শেখ মুজিবুর রহমান। গান্ধী ও জিন্নার শেষ জীবনের ইচ্ছা পূর্ণ না হওয়া নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, অনেক বই বেরিয়েছে। শেখ মুজিবের মৃত্যুপূর্ববর্তী শেষ জীবনের ইচ্ছা এবং তা পূর্ণ না হওয়া সম্পর্কে এখনো তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। কোনো বই বেরোয়নি। (শেষাংশ আগামী শুক্রবার)
লন্ডন, ৩০ জুন, শনিবার, ২০১২

বুধবার, ২৭ জুন, ২০১২

শূন্যতার রাজনীতিতে নতুন যোগফল কী দাঁড়াবে?

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী


বহু বছর আগের কথা। ফিদেল ক্যাস্ট্রো একবার কিউবার রাজধানী হাভানা থেকে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথে কলকাতায় তাঁর ঘণ্টা দু’য়েকের যাত্রাবিরতি। খবর পেয়ে কলকাতার অনেক সাংবাদিক দমদমের বিমানবন্দরে গিয়ে হাজির। সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ক্যাস্ট্রো তাঁদের একটা প্রশ্ন করেছিলেন। বলেছিলেন, শুনেছি ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির সংখ্যা অনেক। এই সংখ্যা কতটা তা জানতে পারি? সাংবাদিকরা জবাব দিয়েছিল, ছোট বড় মিলিয়ে লেফ্ট পার্টির সংখ্যা সতেরোটির কম হবে না। সতেরোটি? বিস্ময়ে ক্যাস্ট্রো চোখ কপালে তুলেছিলেন? তারপর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, তাহলে ভারতে কমিউনিজম ও কমিউনিস্ট পার্টির ভবিষ্যত কী?
ক্যাস্ট্রো এখন বয়োবৃদ্ধ এবং চলাফেরায় প্রায় অক্ষম। তা না হলে কোন কারণে তিনি এখন ঢাকায় এসে যদি শুনতেন, ক্ষমতাসীন মহাজোটে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা হচ্ছে চৌদ্দটি এবং বিরোধী চারদলীয় জোট ফুলেফেঁপে হয়েছে আঠারোটি; নির্ঘাত তিনি তাঁর চোখ আরও বেশি কপালে তুলতেন এবং বলতেন, এ দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যত কী?
ভাল কথা, আমরা বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে গদগদ। কিন্তু ব্যাঙের ছাতার মতো এত দলের যদি উৎপত্তি হয়, তাহলে কোন্টি আসল এবং কোন্টি নকল দল তা বাছাই করা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। আসলের বদলে তখন চলে নকল গণতন্ত্রের রাজত্ব। যা বাংলাদেশে বহুকাল চলেছে। এক সময় গ্রামের দিকে হিন্দু মেয়েদের নাম আন্নাকালী রাখা হতো। এই নামের উৎপত্তির কারণ জেনে বাংলাদেশের বহুদলীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে তার তুলনা করেছি। 
এক স্বামী-স্ত্রীর সন্তান হয় না। বহু বছর তারা কালীমন্দিরে একটি সন্তানের আশায় ধর্ণা দিয়েছেন। পাঁঠা শিরনি মানত করেছেন। অবশেষে কালীমাতা সাধনায় তুষ্ট হলেন। দম্পতি একটি কন্যা সন্তান লাভ করলেন। দম্পতি খুব খুশি। কিন্তু পরের বছরও তাদের একটি কন্যা সন্তান হলো। তার পরের বছরও। যখন তাদের কন্যা সন্তানের সংখ্যা দশ অতিক্রম করল তখন ভয় পেয়ে ওই দম্পতি একাদশ কন্যার নাম রাখল ‘আর না কালী’। অর্থাৎ আর সন্তান চাই না কালী। ওই আর না কালীরই সংক্ষেপ হচ্ছে আন্নাকালী।
বাংলাদেশেও সম্প্রতি যেভাবে যদু মধু ছদু দ্বারা রাজনৈতিক দল নাম নিয়ে ব্যাঙের ছাতা গজাতে শুরু করেছে, তাতে সাম্প্রতিক কোন রাজনৈতিক দলের নাম আন্নাকালী হলে মন্দ হয় না। দিন দুই হয় ঢাকা থেকে এক বন্ধু টেলিফোনে জানিয়েছেন, মাহমুদুর রহমান মান্নাও এখন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন। ইতোপূর্বেই তাঁর এই পাঁয়তারা শুরু হয়েছিল। তখনই তাঁর এই পাঁয়তারা দেখে আমি লিখেছিলাম, এটা পূর্বরাগ-পর্ব। অনুরাগ-পর্ব হয়ত শীঘ্রই শুরু হবে। আমার বন্ধুর দেয়া খবরটি সঠিক হলে বলতে হবে, অনুরাগ পর্বের পরই মিলনের মালা বদল, অর্থাৎ দল গঠন।
মাহমুদুর রহমান মান্না ও ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর রাজনৈতিক চরিত্রের মধ্যে একটা মিল আছে। তাঁরা শুধু পলিটিশিয়ান নন, একাডেমিশিয়ানও। এই দু’য়ের মিলনে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ও কাক্সিক্ষত নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটা উচিত ছিল। কিন্তু তা ঘটেনি। মান্না এবং কোরেশী দু’জনেই বহুবার দল ও মত পরিবর্তন করেছেন। ফেরদৌস কোরেশী তো আওয়ামী লীগ, আতাউর রহমান খানের জাতীয় লীগ, জেনারেল ওসমানীর জনতা পার্টি থেকে জিয়াউর রহমানের বিএনপি- কোন দল পরিভ্রমণই বাকি রাখেননি। শেষ পর্যন্ত এক এগারোর অনুগ্রহে ও আনুকূল্যে হোন্ডাপার্টিও (আসল নামটা ভুলে গেছি) গঠন করেছিলেন। 
মান্না সম্ভবত রাজনীতি শুরু করেছিলেন একটি ইসলামী ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে। তারপর ইউটার্ন দিয়ে জাসদ, পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ এবং কিছুকাল ইন্ডিপেন্ডেন্ট থাকার পর এখন নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ। ড. কামাল হোসেন ও ড. ইউনূসের মতো ইনটেলেকচুয়াল পলিটিশিয়ানদের সঙ্গে এই দুই একাডেমিক পলিটিশিয়ানের বড় মিল এই যে, এদের রাজনৈতিক মত ও পথের কোন স্বচ্ছ স্থির কেন্দ্র নেই। নিজেদের সুবিধার জন্য এরা ডানে বাঁয়ে দুদিকেই হেলতে পারেন।
ঢাকার বন্ধুর মুখে শুনেছি, নয়া দল গঠনের প্রস্তুতি পর্ব হিসেবে মাহমুদুর রহমান মান্না একটি সমাবেশ ঘটিয়েছেন এবং নতুন দল গঠিত হলে প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হক এবং প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা দলটির উপদেষ্টাও হতে পারেন। খবরটি এখনও শোনা কথার পর্যায়ে। তবে এবিএম মূসাকে মান্নার সমাবেশে যোগ দিতে দেখা গেছে। বুড়ো বয়সে ভীমরতি না হলে মূসা কোন ভুঁইফোড় রাজনৈতিক দলে উপদেষ্টা হতে যাবেন আমার তা বিশ্বাস হয় না। ব্যারিস্টার রফিকুল হক যেতে পারেন। তিনি তো এমনিতেই বয়স ও অভিজ্ঞতার সুবাদে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিরোধী দলের নেত্রী পর্যন্ত সকলকে সদুপদেশ দিয়ে থাকেন। সুতরাং নতুন পুরনো যাই হোক একটি রাজনৈতিক দলের প্লাটফরম পেলে তিনি আরও নিয়মিত ভাবে সকলকে সদুপদেশ দিতে পারবেন। দল তাঁর মর্যাদা বাড়াবে না। তিনিই নাম গোত্রহীন দলটিকে কিছু মর্যাদা দিতে পারবেন। ইদানীং মাহমুদুর রহমান মান্নার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগও দেখা যাচ্ছিল।
রাজনীতির সঙ্গে যদি নীতিই না থাকে, তাহলে নতুন দল গঠন করে লাভ কি তা আমি জানি না। কেবলমাত্র নিজেকে স্বঘোষিত নেতা বানানো এবং সঙ্গে কিছু সুযোগ সন্ধানী অনুসারী নিয়ে রাজনীতির জল ঘোলা করা ছাড়া আর কোন লাভ হয় না। এই ধরনের দল বা দলনেতারা সাময়িকভাবে কখনও কখনও সফল হন, নেতা বা মন্ত্রী হন। তারপর জনগণের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে ড্রয়িংরুম রাজনৈতিক নেতায় পরিণত হন। মাহমুদুর রহমান মান্না নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের আগে যদি একবার পেছনে ফিরে তাকান, তাহলে বর্তমানে সাইনবোর্ডসর্বস্ব রাজনৈতিক নেতায় পরিণত হয়েছেন এমন বহু নাম তিনি দেখতে পাবেন। তাঁরা তাঁর চাইতে কম খ্যাতিমান ছিলেন না। এখনও খ্যাতিমান। কেউ কেউ আন্তর্জাতিক খ্যাতির অধিকারী।
এঁদের নামের তালিকাটি দীর্ঘ করব না। কয়েকজন প্রধান ব্যক্তির নাম শুধু উল্লেখ করছি। ড. কামাল হোসেন, ড. ইউনূস, ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কর্নেল (অব) অলি আহমদ, সিরাজুল আলম খান, জেনারেল ইব্রাহিম বীরবিক্রম, কাদের সিদ্দিকী, ফেরদৌস কোরেশী। বাকি অনেক নাম উল্লেখ করার মতো নয়। বিএনপির ১৮ দলীয় জোটের মধ্যে এমন দল আছে, যাদের অস্তিত্ব মাইক্রোস্কোপ দিয়ে আবিষ্কার করতে হয়।
এঁরা সকলেই রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন রাজনীতিতে নীতি ও স্বচ্ছতা সৃষ্টির দোহাই পেড়ে। রাজনৈতিক সততা ও স্বচ্ছতার কথা যিনি সবচাইতে বেশি বলেন, সেই ড. কামাল হোসেন তাঁর গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক পদে বসিয়েছেন এমন এক ব্যক্তিকে, যিনি বঙ্গবন্ধু দ্বারা তিরস্কৃত হয়েছিলেন এবং খুনের অভিযোগে শেখ হাসিনার আমলে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। কর্নেল অলি একবার নিজে রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন, ডা. বি চৌধুরীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন এবং সবশেষে আবার বেগম জিয়ার আশ্রয়ে ফিরে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য কাদের সিদ্দিকীকে বলা হতো বাঘা সিদ্দিকী। এখন তাঁকে কেন ব্রিজ (সেতু) সিদ্দিকী বলা হয়, তার কারণ তিনি কাউকে বলেন না। ডা. বি চৌধুরীর দলে তাঁর পুত্র মাহী চৌধুরী ছাড়া আর কোন প্রকৃত অনুসারী আছে বলে আমার জানা নেই। ফেরদৌস কোরেশীর এক এগারোর আমলে গঠিত দলে মানুষের বদলে হোন্ডাবাইকের সংখ্যা ছিল বেশি।
বাংলাদেশে এখনও কিছু প্রকৃত বাম গণতান্ত্রিক দল আছে। তাদের আগের প্রভাব ও শক্তি নেই তার কারণ, কিছুটা আন্তর্জাতিক (সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব শিবিরে বিপর্যয়), কিছুটা তাদের মধ্যে অনৈক্য ও বিভ্রান্তি। বাংলাদেশে যতদিন বাম গণতান্ত্রিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হতে না পারবে, ততদিন পর্যন্ত কমবেশি ভারতের মতো রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করবে। অর্থাৎ বড় দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যেই রাজনীতির পালাবদল সীমাবদ্ধ থাকবে। ভারতে এ দুটি দলের একটি সেকুলারিস্ট কংগ্রেস এবং অন্যটি সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী বিজেপি। এ দুটি দলও এখন জোট রাজনীতির ওপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশে অনুরূপ দুটি প্রধান দল হলো, একটি সেকুলারিস্ট আওয়ামী লীগ এবং অন্যটি সাম্প্রদায়িক অথবা সাম্প্রদায়িকতা-ঘেঁষা বিএনপি। এই দুটি দলও রাজনীতিতে জোটনির্ভর। একটি চৌদ্দ দলীয় মহাজোট এবং অন্যটি আঠারো দলীয় জোট। মহাজোটে যেমন অন্যান্য শরিক দলের তেমন কোন প্রভাব ও ভূমিকা নেই, তেমনি আঠারো দলীয় জোটেও একমাত্র জামায়াত ছাড়া বাকিদের ভূমিকা এবগেন্টি ল্যান্ডমর্ডের মতো।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সততা ও স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে হলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই দুটি দলেই রিফর্ম ও রিঅর্গানাইজেশন দরকার। এই দুটি দলের মধ্যেই দেশের দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের গডফাদার নব্যধনীরা আশ্রয় নিয়েছে এবং প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে। এই দুই প্রভাববলয় ভাঙ্গা কারো পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না। বরং যারা রাজনীতিতে সততা, স্বচ্ছতা ও অসাম্প্রদায়িকতা এবং দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত পরিবেশের কথা বলছেন, তাঁরা সকলেই কেউ পরোক্ষভাবে কেউ প্রত্যক্ষভাবে এই দুই জোটের সঙ্গে জড়িত। অনেকে রাজনীতিতে তৃতীয় ধারা সৃষ্টির কথা বলেন। কিন্তু বহমান দুই ধারার স্রোতেই তাঁরা সকলে সাঁতার কাটছেন।
আওয়ামী লীগকে শোধরাতে হলে তার ভেতরে বসেই কঠোর প্রতিজ্ঞা নিয়ে বর্তমানের দক্ষিণপন্থী ও সুবিধাবাদী কায়েমী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। সুযোগ সন্ধানী মনোভাব নিয়ে নিশ্চুপ ঘরে বসে সুযোগের অপেক্ষায় থাকলে চলবে না। বিএনপির বেলাতেও একই কথা। খালেদা জিয়াকে জামায়াতীদের কোলে আরও ঠেলে না দিয়ে, তারেক রহমানের মতো দুর্বৃত্ত নেতৃত্বের জন্য দলের দরজা খুলে না রেখে দলের ভেতরে বসেই ডা. বি চৌধুরী বা অলি আহমদের মতো নেতাদের উচিত ছিল দলটিকে জামায়াত ও সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের খপ্পর থেকে মুক্ত করার জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। তাঁরা তা করেননি। ক্ষমতার লোভে বেগম জিয়া এবং তাঁর পুত্রের প্রতিটি ‘হুইমের’ কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন এবং আত্মসমর্পণ করেও যখন কোন লাভ হয়নি, তখন দল ত্যাগ করেছেন অথবা দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন।
আওয়ামী লীগেও দলের ভেতরে এসেই তার আগেকার স্বচ্ছ ও প্রগতিশীল রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে হবে। হাসিনা-নেতৃত্বকে সঠিক পথে ধরে রাখতে হবে। কারণ এই নেতৃত্বের বিকল্প দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এখনও তৈরি হয়নি। যাঁরা স্বচ্ছ ও সুস্থ রাজনীতির নামে এই নেতৃত্বকে আঘাত করতে চাইছেন, নতুন দল গঠন করছেন, তাঁরা নিজেরা অস্বচ্ছ ও অসুস্থ রাজনীতির মধ্যে ডুবে যাচ্ছেন এবং দেশের সেকুলার ও গণতান্ত্রিক শিবিরকেই বিভক্ত ও দুর্বল করার চেষ্টা করছেন। ড. কামাল হোসেন এই স্বচ্ছ ও সুস্থ রাজনীতির ধুয়ো তুলে দেশের রাজনীতিকে আরও বেশি অস্বচ্ছ ও অসুস্থ পরিবেশে ঠেলে দিয়েছেন। নিজেও বিতর্কিত হয়ে গেছেন। বয়সে তরুণ মাহমুদুর রহমান মান্নাও এর ব্যতিক্রম হবেন না।
আমার ধারণা, মাহমুদুর রহমান মান্না যদি সত্যই নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে, তাহলে বিএনপিরই হয় তো আখেরে লাভ হবে। তাদের জোটে সদস্য সংখ্যা বাড়বে এবং ১৮ দলীয় জোটের বদলে উনিশ দলীয় জোট তৈরি হবে। শূন্য+শূন্য+শূন্য, যোগফল শূন্য। মান্নার দলও এই শূন্যতার রাজনীতিতে যুক্ত হবে।
ল-ন ২৬ জুন, মঙ্গলবার, ২০১২ ॥

শনিবার, ২৩ জুন, ২০১২

২৩ জুন :পলাশী থেকে রোজ গার্ডেন


আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
দেশের মানুষ শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে এখনও স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ভগ্নপ্রায় ঘাঁটির শেষ ভরসা বলে মনে করেন। আওয়ামী লীগকে বাঁচিয়ে রাখার কৃতিত্ব হাসিনা-নেতৃত্ব যেমন দাবি করতে পারে, দলটিকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার অসম্ভব কাজ সম্ভব করার সাফল্যেরও দাবি জানাতে পারে, তেমনি এই বাস্তবতাও স্বীকার করে নিতে হবে যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চতুর্থ যুগের আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর স্বর্ণযুগের মহিমা ধরে রাখতে পারেনি

ইতিহাস আমার প্রিয় সাবজেক্ট এবং আমি ইতিহাসের ছাত্র বলেই কি-না জানি না, ইতিহাসের অনেক ঘটনা ও তারিখের মধ্যে একটা কাকতালীয় সামঞ্জস্য যেন দেখতে পাই। প্রথম মহাযুদ্ধের পর একটি নদীর তীরে যে স্থানটিতে এবং যে তারিখে পরাজিত জার্মান সেনাবাহিনী ফ্রান্সের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল, কুড়ি বছর পর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় পরাজিত ফরাসিরা ওই নদী তীরে একই তারিখে জার্মানির কাছেও আত্মসমর্পণ করে।
বাংলাদেশের ইতিহাসেও এ ধরনের একটি তারিখের বৈশিষ্ট্য আমার চোখে ধরা পড়ে। তারিখটি ২৩ জুন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং এই যুদ্ধে নবাব সিরাজউদৌল্লার পরাজয়ের ফলে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। ওই বছর ৩ জুলাই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। আমাদের ছেলেবেলায় ব্রিটিশ আমলে স্কুলের ছাত্র থাকাকালে আমরা ২৩ জুন পলাশী দিবস এবং ৩ জুলাই শহীদ নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা দিবস পালন করতাম।
এখন আড়াইশ' বছর পর বাংলাদেশে ২৩ জুন তারিখটি আমরা পালন করি অন্যভাবে। এ দিনটি এখন দেশের অর্ধ শতকেরও বেশি সময়ের প্রাচীন এবং সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দল আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা দিবস। ইতিহাসের কাকতালীয় ব্যাপার এই যে, ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের মাঠে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। ঠিক তার ১৯২ বছর পর ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার হাটখোলা রোড সংলগ্ন রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে যে দলটি গঠিত হয় এবং পরে আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে সেই দলের নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধেই বাংলাদেশে আবার স্বাধীনতা সূর্যের উদয় ঘটে।
আজ সেই ২৩ জুন। দলটির ৬৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী দিবস। এই ৬৩ বছরে আওয়ামী লীগ বহুবার খোলস পাল্টেছে। এই খোলস পাল্টানোর মধ্য দিয়ে তার নেতৃত্ব ও চরিত্র পাল্টেছে। আওয়ামী লীগ তার নেতৃত্ব ও চরিত্রের তিনটি যুগ অতিক্রম করে বর্তমানে চতুর্থ যুগ অতিক্রম করছে। নেতৃত্ব বদলের সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের চরিত্রেরও বদল ঘটেছে।
প্রতিষ্ঠাকালের আওয়ামী লীগের চরিত্র ছিল একটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। অবশ্য মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িক দলের খোলস পাল্টে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। মওলানা ভাসানীকে এ কাজে সাহায্য জোগান তার দলের তরুণ সেক্রেটারি শেখ মুজিবুর রহমান এবং দলের প্রগতিশীল তরুণ অংশ।
আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় যুগের নেতৃত্বে ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি দলের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র মেনে নিলেও দলের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চরিত্র বদলে ফেলেন। তিনি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সমর্থনে পার্লামেন্টে মাত্র ১৩ জন সদস্য নিয়ে সামরিক বাহিনীর দল রিপাবলিকান পার্টির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গঠন করেন এবং নিজে প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তিকে সমর্থন দেন। বাংলাদেশের (তখনকার পূর্ব পাকিস্তান) পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ছিল আওয়ামী লীগের মূল দাবি। তিনি সেই দাবি থেকে সরে এসে বলতে থাকেন, পূর্ব পাকিস্তানকে শতকরা ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়ে গেছে। পশ্চিম পাকিস্তানেও অগণতান্ত্রিকভাবে চাপিয়ে দেওয়া এক ইউনিট প্রথাকে তিনি সমর্থন দেন। ১৯৫৭ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনে তিনি দলের আরেকটি মূলনীতি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি বর্জন করেন।
ফলে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল অংশের একটা বড় চাঙ্ক দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। এ সময় যদি শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিয়ে ন্যাপে চলে যেতেন, তাহলে আওয়ামী লীগের সম্ভবত তখনই মুসলিম লীগের পরিণতি ঘটত। দলটির পুনরায় মাথা তোলার কোনো সুযোগ থাকত না। শহীদ সোহরাওয়ার্দীও দলের মূলনীতি থেকে সরে গিয়ে বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। মাত্র ১৩ মাসের মাথায় প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা তাকে ডেকে নিয়ে পদত্যাগপত্রে সই আদায় করেন।
এ সময়ের কথা পর্যালোচনা করতে গিয়ে ১৯৭৩ সালে আবু জাফর শামসুদ্দীন তার এক রাজনৈতিক নিবন্ধে লিখেছিলেন, 'আল্লাহর অসীম মেহেরবানি, সাতান্ন সালে শেখ মুজিব ন্যাপে চলে যাননি। যদি যেতেন, তাহলে বাংলাদেশের ভাগ্যের চাকা অন্যদিকে ঘুরে যেত। আওয়ামী লীগ প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে যেত। ন্যাপ শক্তিশালী হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা তার কাছে প্রায়োরিটি পায়নি। ন্যাপের মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রেখে নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ। ন্যাপের দ্বারা তিনি প্রথমে ছয় দফা গ্রহণ করাতে পারতেন না এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানের জন্যও তিনি দলকে সংগঠিত অথবা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন না।
এই বয়োজ্যেষ্ঠ প্রয়াত লেখকের সঙ্গে আমি সহমত পোষণ করি। নিজের আপসবাদী নীতির দরুন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এমনিতেই আওয়ামী লীগকে বিভক্ত ও দুর্বল করে ফেলেছিলেন। ক্ষমতাচ্যুতির পর তখনকার পশ্চিম পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তান কোথাও তিনি আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী গণপ্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকিয়ে রাখতে পারতেন না। তিনি এর আগে পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন নেতাকে সঙ্গে নিয়ে জিন্নাহ মুসলিম লীগ নামে নতুন দল গঠন করেও তা টিকিয়ে রাখতে পারেননি।
এখানে হয়তো প্রাসঙ্গিক নয়, তবু একটা কথা লিখছি। ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের জেল থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে এক ভারতীয় কূটনীতিক তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, '১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ দলটি গঠিত হয় এবং এর নামকরণ হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী দ্বারা।' কথাটি সঠিক নয়। ঢাকার রোজ গার্ডেনে দলটি গঠিত হওয়ার সময় আওয়ামী মুসলিম লীগ এই নামটি দেন মওলানা ভাসানী।
এ প্রসঙ্গে ভাসানী বলেছিলেন, মুসলিম লীগ দল জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নবাব খাজা গজাদের মুসলিম লীগে পরিণত হয়েছে। আমরা আওয়ামের অর্থাৎ জনগণের মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করলাম। ঢাকায় আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হওয়ার সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন করাচিতে। তিনি মাঝে মধ্যে লাহোরেও থাকতেন। সেখানে বসে তিনি জিন্নাহ মুসলিম লীগ নামে একটি নতুন দল গঠন করেছিলেন। সেই দল টেকেনি। ঢাকায় আওয়ামী মুসলিম লীগ দল গঠিত হওয়ার কিছু পর তিনি মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের আহ্বায়কের পদ গ্রহণ করেন। মওলানা ভাসানী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি। তিনি দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গ্রহণ করেননি।
আইয়ুব আমলের প্রায় শেষ দিকে আইয়ুববিরোধী সম্মিলিত আন্দোলনের নামে সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগের বিলুপ্তি ঘটান। অন্যান্য রাজনৈতিক দলও তার অনুরোধে তাকে অনুসরণ করে এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) নামে একটি সর্বদলীয় মোর্চা গঠিত হয়। এনডিএফ জনপ্রিয় হয়নি। বরং অল্পদিনের মধ্যে নাথিং ডুয়িং ফ্রন্ট নামে পরিচিত হয়। সোহরাওয়ার্দী অসুস্থ হয়ে বিদেশে চলে যান এবং বিদেশেই মৃত্যুবরণ করেন।
আওয়ামী লীগ ১৯৫৫ সালে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হওয়ার পরও সোহরাওয়ার্দী নেতৃত্বের আপসবাদিতার জন্য দেশের রাজনীতিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেননি। সোহরাওয়ার্দীর আকস্মিক মৃত্যুর পর দলের প্রবীণ নেতাদের প্রবল আপত্তি ও বাধাদানের নীতি অগ্রাহ্য করে শেখ মুজিব দলের পুনরুজ্জীবন ঘটান এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ও চরিত্রকে সম্পূর্ণ নতুন ধারায় পুনর্গঠন করেন। সাম্রাজ্যবাদ ও সামরিক চুক্তির বিরোধিতা এবং নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি আওয়ামী লীগের দাবি হয়ে দাঁড়ায়। শেখ মুজিব সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে দলীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং বাংলাদেশের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন অথবা স্বাধীনতার পূর্বপ্রস্তুতির কর্মসূচি হিসেবে 'বাংলায় ম্যাগনাকার্টা' ছয় দফা ঘোষণা করেন।
শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পুনর্গঠিত আওয়ামী লীগের এই তৃতীয় যুগকেই দলটির গৌরবোজ্জ্বল স্বর্ণযুগ বলা হয়। আওয়ামী লীগ দেশের অপ্রতিদ্বন্দ্বী দল এবং শেখ মুজিব অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতায় রূপান্তরিত হন। এই তৃতীয় যুগে আওয়ামী লীগের শুধু নীতি ও নেতৃত্ব নয়, চরিত্রেরও সম্পূর্ণ বদল ঘটে। প্রথম যুগের আওয়ামী লীগ ছিল একটি সাম্প্রদায়িক নিয়মতান্ত্রিক দল। দ্বিতীয় যুগে দলের সাম্প্রদায়িক চরিত্র বদল হলেও নেতৃত্ব ছিল আপসবাদী ও পশ্চাৎমুখী। তৃতীয় যুগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ও চরিত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। দুর্বল, আপসবাদী নেতৃত্বের বদলে শেখ মুজিবের শক্তিশালী সংগ্রামী নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠা ঘটে। আপসবাদী নেতারা সোহরাওয়ার্দী-রাজনীতির লেগাসি বহন করে আইয়ুব আমলে পিডিএমপন্থি আওয়ামী লীগ নাম দিয়ে দলটি ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। তারা পারেননি। মুজিব নেতৃত্বের শক্তিশালী জোয়ারের ধাক্কায় তারা ভেসে গেছেন।
প্রথম যুগে আওয়ামী লীগ ছিল একটি সাম্প্রদায়িক দল। দ্বিতীয় যুগে একটি অসাম্প্রদায়িক আধা পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক দল। তৃতীয় যুগে অর্থাৎ মুজিব নেতৃত্বের আমলে দলটির পূর্ণ উত্তরণ ঘটে সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচির রাজনীতিতে। দলটি একটি সোস্যাল ডেমোক্রেট দলে পরিণত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দলটির নামের সঙ্গে কৃষক শ্রমিক কথাটি যোগ করে দলটিকে একটি সমাজবাদী মোর্চায় পরিণত করার এবং দেশকে একটি সোস্যাল ডেমোক্রেসিতে রূপান্তরিত করার উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে তিনি তৎকালীন পশ্চিম ইউরোপীয় সোস্যাল ডেমোক্রেসির ধারা অনুসরণ না করে পূর্ব ইউরোপীয় ধারা অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন। এর নাম তিনি দিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিপ্লব।
দলে এবং দেশের ভেতর বঙ্গবন্ধু এই বিপ্লব সফল করতে পারেননি। দেশের প্রতিবিপ্লবীরা, সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদ, মস্ক এবং মিলিটারি হাত মিলিয়ে তাকে হত্যা করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল ভিত্তিগুলোর ওপর তারা আঘাত হানতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী কয়েকটা বছর বাংলাদেশ এবং আওয়ামী লীগের জন্য এক অন্ধকার যুগ। আইয়ুব আমলে যেমন পিডিএমপন্থি আওয়ামী লীগ গঠন করে প্রকৃত আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার চেষ্টা হয়েছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে লিটল আইয়ুব জিয়াউর রহমানের আমলে তেমনি মিজানুর রহমান চৌধুরী, ইউসুফ আলী প্রমুখ কয়েকজন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতার দ্বারা সোহরাওয়ার্দী-আওয়ামী লীগ গঠন করে তখনকার সেনা শাসকরা আইয়ুবের মতো একই কায়দায় এই সংগ্রামী দলটিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। আইয়ুবের মতোই তারা ব্যর্থ হলেন।
আওয়ামী লীগের চতুর্থ যুগের শুরু শেখ হাসিনার নেতৃত্ব গ্রহণের পর। আবু জাফর শামসুদ্দীনের কথাকে অনুকরণ করে বলতে হয়, আল্লাহ মেহেরবান, তাই বঙ্গবন্ধুর সকল পুত্র, এক ভাগ্নে, ভগি্নপতিসহ পরিবারের অনেক পুরুষ ও নারী সদস্য শহীদ হওয়ার পরও তার দুই কন্যা হাসিনা ও রেহানা বেঁচে গেছেন এবং দলের ও দেশের চরম দুর্দিনে সকল প্রতিকূলতার মধ্যে শেখ হাসিনা গৃহবধূর ভূমিকা থেকে রাজনৈতিক নেত্রীর ভূমিকায় উঠে আসার সাহস ও প্রজ্ঞা দেখিয়েছেন।
এই সময় নেতৃত্বহীন এবং নেতৃত্বের কোন্দলে জর্জরিত আওয়ামী লীগের নৌকার হাল যদি শেখ হাসিনা না ধরতেন, তাহলে দলটির অস্তিত্বই শুধু বিপন্ন হতো না, দেশে মুক্তিযুদ্ধের নিবু নিবু প্রদীপটিও একেবারেই নিভে যেত। সেনা শাসক এবং তাদের সিভিল ফেস বিএনপির আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ এমন অপ্রতিরোধ্যভাবে মাথা তুলত যে, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের ধ্বংসযজ্ঞের আগুন বাংলাদেশে এসে ছড়িয়ে পড়ত।
দেশে বামপন্থি ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক দল এখন এতই দুর্বল যে, দেশের মানুষ শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে এখনও স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ভগ্নপ্রায় ঘাঁটির শেষ ভরসা বলে মনে করেন। আওয়ামী লীগকে বাঁচিয়ে রাখার কৃতিত্ব হাসিনা-নেতৃত্ব যেমন দাবি করতে পারে, দলটিকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার অসম্ভব কাজ সম্ভব করার সাফল্যেরও দাবি জানাতে পারে, তেমনি এই বাস্তবতাও স্বীকার করে নিতে হবে যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চতুর্থ যুগের আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর স্বর্ণযুগের মহিমা ধরে রাখতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর সোস্যাল ডেমোক্রেট দলটি আবার একটি আধা পুঁজিবাদী ট্রাডিশনাল গণতান্ত্রিক দলের আপসবাদী চরিত্রে ফিরে এসেছে। এটা অগ্রসর হওয়া নয়, পশ্চাদপসারণ।
অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর আমলের পরিস্থিতি এখন নেই এবং যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক দলেও যুগোপযোগী সংস্কার ও পরিবর্তন প্রয়োজন। কিন্তু দলটি মূল লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে আসতে পারে না। হাসিনা-নেতৃত্বের সাহস ও দেশপ্রেম অনস্বীকার্য। কিন্তু তার চরিত্রে আপস ও পিছিয়ে আসার প্রবণতাও লক্ষণীয়। বর্তমানে আওয়ামী লীগ ক্রমশই তার মৌলিক চরিত্র হারাচ্ছে। সংগঠন দ্রুত শক্তি ও জনসম্পৃক্ততা হারাচ্ছে। দলে নতুন রক্ত সঞ্চালন নেই। যেসব নতুন মুখ দলে বা সরকারে দেখা যাচ্ছে, তাদের অধিকাংশই অদক্ষ, অযোগ্য ও চাটুকার ধরনের। ৬৩ বছর বয়সেই মনে হয় দলটিকে অকাল বার্ধক্যে ধরেছে। হাসিনা-নেতৃত্বের সাফল্য অনেক। কিন্তু ব্যর্থতাগুলোই এখন বেশি প্রকট। আওয়ামী লীগের ৬৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী দিবসে তাই এই সতর্ক বাণীটি উচ্চারণ করা প্রয়োজন মনে করছি_ 'দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ।'
লন্ডন, ২২ জুন ২০১২, শুক্রবার

বুধবার, ২০ জুন, ২০১২

জাসদ-নেতার মাইনাস ওয়ান থিওরি

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী


বাংলাদেশে একটি কথা প্রচলিত আছে। ‘রোগ সারলেও তার প্রতিক্রিয়া অনেকদিন দেহে থাকে।’ কথাটি যে সত্য তা রাজনৈতিক রোগের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। বাংলাদেশে এক এগারোর সময় ‘মাইনাস টু’ নামে যে থিওরিটি গজিয়ে উঠেছিল, আসলে তা ছিল দেশের রাজনীতির শরীরে একটি সংক্রামক রোগ। এই রোগটি আপাতত সেরে গেছে। কিন্তু রোগের প্রতিক্রিয়া থেকে দেশের রাজনীতির শরীর মুক্ত হয়নি। 
তার প্রমাণ, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে বিদায় নেয়ার জন্য জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদের সভাপতি এবং সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনুর বারম্বার আহ্বান বা দাবি জানানো। আমার ধারণা, এক এগারোর সময় শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টাকে যেমন মাইনাস টু থিওরি আখ্যা দেয়া হয়েছিল, তেমনি এখন খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরে যাওয়ার জন্য হাসানুল হক ইনু একাধিকবার যে আহ্বান জানিয়েছেন, তাকে মাইনাস ওয়ান থিওরি আখ্যা দেয়া যেতে পারে। আগের মাইনাস টু থিওরিটি (আসলে সেটিও ছিল মাইনাস ওয়ান থিওরি। টার্গেট ছিলেন শেখ হাসিনা) যেমন কার্যকর করা সম্ভব হয়নি, তেমনি বর্তমানের মাইনাস ওয়ান থিওরিটিও খালেদা জিয়া বিবেচনা করবেন অথবা কার্যকর করা যাবে, তা আমি বিশ্বাস করি না। 
আগের মাইনাস টু থিওরির উদ্ভাবক হিসেবে দেশের সুশীল-কুশীল সমাজ, হতাশ ও ব্যর্থ রাজনৈতিক নেতা, ক্ষমতালোভী একশ্রেণীর সাবেক সেনা কর্মকর্তা, আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও পুরস্কারের অধিকারী, কিন্তু নিজ দেশে একঘরে এমন অনেক ব্যক্তি ও মহলের কথা আমরা জানি। কিন্তু জাসদ নেতার একক প্রচারিত এই থিওরির উদ্ভাবক কেবল তিনি নিজে, না এর উদ্ভাবনার পেছনে আরও কারও মাথা কাজ করছে তা আমি জানি না।
হাসানুল হক ইনু এর আগেও একবার বলেছেন, তিনি খালেদা জিয়াকে রাজনীতি ত্যাগে বাধ্য করবেন। কিভাবে করবেন সেই পন্থাটির কথা তখন তিনি প্রকাশ করেননি। এবার তার দাবি বেগম জিয়াকে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গীবাদী মৌলবাদ এবং যুদ্ধাপরাধী এই তিন অশুভ চক্রের সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে। নতুবা তাঁকে রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে হবে। গত ৯ জুন শনিবার বিকেলে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে কালো পতাকা মিছিল শেষে অনুষ্ঠিত সমাবেশে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি বলেন, ‘দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংঘর্ষময় করে তোলার জন্য দায়ী হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গী মৌলবাদ, ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী এই তিন চক্র।’ অতঃপর খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছেন, ‘আপনি এই অশুভ তিন চক্রের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। অবিলম্বে এদের সঙ্গ বর্জন করুন। নতুবা রাজনীতি থেকে বিদায় নিন।’
এই সমাবেশে ‘বেগম খালেদা জিয়া ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করুন’ এই কথা লেখা ব্যানার টানানো হয়েছিল এবং সমাবেশ শেষে গোলাম আযম ও মতিউর রহমান নিজামীর কুশপুত্তলিকায় এলোপাতাড়ি লাথি মারা ছাড়াও তাতে অগ্নি সংযোগ করা হয়। সমাবেশে জাসদ নেতা আরও বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার পৃষ্ঠপোষক হলেন খালেদা জিয়া। তাঁর কারণেই এরা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করার সুযোগ পেয়েছে। খালেদা জিয়া নিজের ঘাড় থেকে চিরদিনের জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিদায় না দিলে সংঘর্ষের রাজনীতি বন্ধ হবে না। রাজনীতি করতে চাইলে খালেদা জিয়াকে এদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে জনতার কাতারে আসতে হবে। তিনি যদি তা না করেন তাহলে তাঁকে রাজনীতি থেকে বিদায় করতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।’
হাসানুল হক ইনুর বক্তব্যের সঙ্গে দেশের অনেকের মতো আমিও সহমত পোষণ করি। তার দাবিটিও সঠিক। কিন্তু তার দাবি আদায়ের পন্থাটি সঠিক নয়। খালেদা জিয়াকে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গ ত্যাগ করতে বলা হলেই তিনি তা করবেন অথবা জাসদ সভাপতি দলীয় মিছিলে বা মিটিংয়ে বক্তৃতা করলেই খালেদা জিয়া রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াবেন এটা ভাবা ভাবালুতা, বাস্তবতা নয়। রাজনীতিতে এই ধরনের দাবি চমক সৃষ্টি করতে পারে; কিন্তু দাবি আদায়ের পন্থা হতে পারে না।
এক এগারোর সময় মইন-ফখরুদ্দীনের তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং বন্দুক দুই-ই হাতে নিয়ে মাইনাস টু থিওরি বাস্তবায়নে নেমেছিলেন। শেখ হাসিনাকে অবৈধভাবে বিদেশে আটকে রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল এবং বেগম জিয়াকে তো প্রায় চৌদোলা করে সউদি আরবে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছিল। সউদি সরকার চালাকি করে বেগম জিয়াকে ভিসা প্রদান আটকে না দিলে বেচারীকে তখন হয়ত রিয়াদে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের পরিত্যক্ত বাড়িটিতে গিয়ে থাকতে হতো। 
মাইনাস টু থিওরি সফল হয়নি। কারণ দেশের মানুষ তা চায়নি। বরং ক্ষমতায় অবৈধ প্রয়োগ দ্বারা এই থিওরি কার্যকর করতে গিয়ে মইন-ফখরুদ্দীন দু’জনেই বাংলাদেশে মাইনাস হয়ে গেছেন। একজন অসুস্থ এবং স্বেচ্ছাগৃহবন্দী এবং অন্যজন বিদেশে স্বেচ্ছানির্বাসিত। এখন হাসানুল হক ইনুর মতো এক বাম রাজনীতির নেতা, যার হাতে সরকারী ক্ষমতাও নেই, তিনি কেবল দলীয় সভায় বক্তৃতা দিয়ে কিংবা আসর গরম করার মতো দাবি তুলে তার মাইনাস ওয়ান (খালেদা জিয়া) থিওরি সফল করতে পারবেন কি? 
আমার ধারণা, সে আশা তিনি নিজেও করছেন না। তাহলে এই মুহূর্তে দেশের জনজীবনে এত সমস্যা থাকতে তিনি খালেদা জিয়াকে একটি ইস্যু করে একটি অবাস্তব দাবি তুলে চমক সৃষ্টির চেষ্টা করছেন কেন? নাকি তিনি ক্ষমতাসীন মহাজোটের অন্তর্ভুক্ত থাকায় কিছু চটকদার দাবি তুলে দেশের প্রাত্যহিক সমস্যাগুলো থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্য দাবির দিকে সরাতে চান এবং একই সঙ্গে চান মহাজোটের নেত্রীকেও খুশি করতে?
উদ্দেশ্য যাই হোক, হাসানুল হক ইনু নিজেও জানেন, গণদাবির প্রচণ্ড চাপ ছাড়া তার দাবি বিএনপি নেত্রী কানে তুলবেন না এবং ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধীরাও এই দাবির কথা শুনে বিচলিত হবে না। তারা জানে, খালেদা জিয়া ক্ষমতার লোভেই তাদের ছাড়বেন না। আর ছাড়তে চাইলেও খালেদা জিয়ার রাজনীতি নেপথ্যে বসে যারা নিয়ন্ত্রণ করেন, তারা তাঁকে ছাড়তে দেবেন না। ইনু কি জানেন না, বর্তমান বিশ্বে ছোট বড় অধিকাংশ দেশের রাজনীতিতে এখনও ব্যক্তি প্রাধান্য থাকলেও সেই ব্যক্তির পেছনে থাকে একটি ইনভিজিবল কোটারি, যারা ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এরা শক্তিশালী সামরিক গোয়েন্দা চক্র, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, দেশী-বিদেশী কায়েমী স্বার্থ, সুশীল সমাজ অথবা এলিট ক্লাসের সুবিধাভোগী অংশও হতে পারে। 
ক্যান্টনমেন্টের এক নিহত জেনারেলের বিধবা স্ত্রীকে (রাজনীতি সম্পর্কে যার কোন ধ্যান ধারণাই ছিল না) রাজনীতিতে টেনে এনেছে এবং ‘দেশনেত্রী’ বানিয়েছে এরাই। উদ্দেশ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার উদ্দেশ্য ও আদর্শ বাস্তবায়ন বানচাল করা এবং জাসদ নেতা কর্র্তৃৃক বর্ণিত তিন অশুভ চক্র বিশেষ করে ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করা। এই উদ্দেশে রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতায় আনা হয়েছে। রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল এরশাদকে ক্ষমতায় আনা হয়েছে। পরে নির্বাচনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে একবার নয়, দু’বার বসানো হয়েছে ক্ষমতায়। তাঁর মাথায় প্রচার প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে দেশনেত্রীর টুপি পরানো হয়েছে।
খালেদা জিয়া বেঁচে থাকতেই তাঁর উত্তরাধিকারীও মনোনীত হয়ে গেছে। সেই উত্তরাধিকারী তাঁরই ‘সুপুত্র’ তারেক রহমান। ক্ষমতায় আসার আগেই তারেক ঘোষণা করেছেন, ‘জামায়াত (৭১-এর যুদ্ধাপরাধীরা) তাদের পরমাত্মীয়, তারা একই পরিবারের লোক।’ এই পারিবারিক বন্ধন মাতা বা পুত্র কেউ ছিন্ন করতে চাইবেন বা পারবেন, তা আশা করা বাতুলতা। কোন কারণে ছিন্ন করতে চাইলে তখন খালেদা জিয়াকে হয়ত নেতৃত্ব থেকে অবসর নিতে বাধ্য করা হবে এবং তারেক রহমানেরও যুবরাজ থেকে রাজা হওয়ার খোয়াব ধূলিসাত হয়ে যাবে।
তখন বিএনপির নেতৃত্বে নতুন নেতা বা নেত্রী আসবেন, এখন অসম্ভব মনে হলেও বিএনপি থেকে সদ্য পদত্যাগকারী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাও নেতৃত্বে চলে আসতে পারেন। তখন ঢাক ঢোল পিটিয়ে তাকেই দেশ নেতা বানানো হতে পারে। কেন, পাকিস্তান আমলে তখনকার প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান চট্টগ্রামের যে ফজলুল কাদের চৌধুরীকে দুর্নীতির দায়ে শুধু তার মন্ত্রিসভা থেকে নয়, কনভেনশন মুসলিম লীগ থেকেও বহিষ্কার করেছিলেন, সেই ফজলুল কাদের চৌধুরীকেই কি আইয়ুব খান নিজে রাজনীতি থেকে বিদায় নেয়ার সময় কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি পদে বসিয়ে যাননি?
আসলে ক্ষমতার রাজনীতিতে ব্যক্তি দৃশ্যত বড়; কিন্তু আসল বড় শক্তি গোত্র। সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গীবাদ ও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী এই তিন চক্র এবং তাদের বিদেশী পৃষ্ঠপোষকদের সমন্বয়ে বাংলাদেশে যে প্রচ- শক্তিশালী অশুভ গোত্র অথবা গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে; খালেদা জিয়া এই গোত্রেরই তৈরি নেতা। তিনি এদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন কি করে? হাসানুল হক ইনুর দাবি মেনে তিনি বিচ্ছিন্ন হতে গেলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন।
অশুভ গোত্র বা ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের কাছ থেকে খালেদা জিয়া বিচ্ছিন্ন হবেন না। বিচ্ছিন্ন হওয়ার ক্ষমতা তার নেই। অসম্ভবকে সম্ভব করে তিনি বিচ্ছিন্ন হলে অশুভ গোত্রের অসুবিধা হবে না। তারা নতুন ‘নেতৃত্ব’ তৈরি করবেন। খালেদা আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন। তবে আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে যদি দেখা যায়, বিএনপিকে নির্বাচনে জয়ী হতে হলে জামায়াতকে বর্জন করতে হবে, তাহলে অশুভ গোত্রের নির্দেশেই জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি এমন একটি কৃত্রিম দূরত্ব সৃষ্টি করবে, যাকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। কিন্তু বঁধূয়ার গোপন পিরিতি অক্ষুণœ থাকবে। নির্বাচনের পর বিএনপি জয়ী হতে পারলে দেখা যাবে কলা আর খোসা আবার এক হয়ে গেছে।
হাসানুল হক ইনু বাংলাদেশের একজন আধুনিক রাজনীতিবিদ। কিন্তু তিনি পুরনো দৃষ্টিভঙ্গিতে দেশের মূল সমস্যাটিকে বিচার করছেন। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গীবাদ, যুদ্ধাপরাধ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস সব কিছু মিলিয়ে সাম্রাজ্যবাদী বহিঃশত্রুর পৃষ্ঠপোষকতায় যে মহাশক্তিশালী ফ্যাসিবাদী দুর্গ গড়ে উঠেছে, একজন ব্যক্তি বা নেতা, তিনি যতই প্রভাবশালী হোন, চলে গেলে বা সরে গেলে সেই দুর্গের তেমন কোন ক্ষতি হবে না।
দেশকে এই ফ্যাসিবাদের কবল থেকে মুক্ত করতে হলে নীতিভিত্তিক ও ইতিবাচক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে দেশের গণতান্ত্রিক দলগুলোকে নামতে হবে। তারা এ পর্যন্ত এই নীতিভিত্তিক, ইতিবাচক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার শক্তি ও আগ্রহের প্রমাণ দেখাননি। সেই আন্দোলন গড়ে না তুলে প্রেসক্লাবের সামনে দলীয় সমাবেশ ডেকে খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর চটকদার দাবি জানানো তালগাছের সামনে একা দাঁড়িয়ে তাকে মাথা নোয়ানোর অনুরোধ জানানোর মতো।
লন্ডন ২০ জুন, বুধবার ॥ ২০১২ ॥

শনিবার, ১৬ জুন, ২০১২

গ্রামীণ ব্যাংক ব্যবস্থার একজন উদ্ভাবকের মৃত্যু


আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
রণজিত গুপ্তের পরিকল্পনায় গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা থাকবে গরিব শেয়ারহোল্ডারদের হাতে। তাদের নির্বাচিত বোর্ড ব্যাংক পরিচালনা করবে এবং এই ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে কোনো এক ব্যক্তির কর্তৃত্বের বদলে সরকারের নজরদারি থাকবে। ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররা ব্যাংকের কার্যক্রম ও হিসাব সম্পর্কে অবহিত থাকবেন এবং মুনাফার অংশ পাবেন

সম্প্রতি কলকাতায় সাবেক পুলিশ কমিশনার এবং পরবর্তী জীবনে নৃতত্ত্ব ও কৃষি গবেষণার জন্য বিখ্যাত একজন পণ্ডিত রণজিত গুপ্ত প্রয়াত হয়েছেন। তিনি কেবল পশ্চিমবঙ্গের নকশাল যুগের একজন দাপুটে পুলিশকর্তা হলে সম্ভবত তার মৃত্যুতে পত্রপত্রিকায় এত অবিচুয়ারি প্রকাশিত হতো না। ইন্দিরা যুগে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুলিশকর্তা হিসেবে তার নাম সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়লেও তার বিশেষ খ্যাতি নৃতত্ত্ব ও কৃষি অর্থনীতি সম্পর্কিত গবেষণায়। চাকরি জীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর প্রায় ৩০ বছর তিনি এই গবেষণায় ও হাতে-কলমের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। এ জন্য নিউইয়র্ক টাইমস তাকে 'ংবষভ ঃধঁমযঃ ধমৎধৎরধহ বীঢ়বৎঃ ধহফ ধহঃযৎড়ঢ়ড়ষড়মরংঃ' (স্বশিক্ষিত কৃষি বিশেষজ্ঞ ও নৃতত্ত্ববিদ) আখ্যা দিয়েছিল।
রণজিত গুপ্তের জন্ম বাংলাদেশে। পরে তারা পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। তার ভাই অশোক গুপ্তের নামের সঙ্গেও আমরা পরিচিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অশোক গুপ্ত ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসে একজন কূটনৈতিক কর্মকর্তা ছিলেন। সেটা বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমল। সুবিমল দত্ত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের প্রথম হাইকমিশনার। অশোক গুপ্ত ছিলেন সম্ভবত প্রেস কাউন্সিলর। তিনি সাহিত্য চর্চাও করেন। 'বিক্রমাদিত্য' এই ছদ্মনামে লেখা তার কিছু বইও বাজারে আছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অশোক গুপ্তকে সামরিক সরকার ৭২ ঘণ্টার নোটিশে ঢাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য করে। তিনি পরে বঙ্গবন্ধু হত্যা সম্পর্কে 'মিডনাইট ম্যাসাকার' নামে একটি বইও লিখেছেন।
অশোক গুপ্তের চেয়ে তার ভাই রণজিত গুপ্তের পরিচিতি অনেক বেশি। পরে কৃষি অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ এবং নৃতাত্তি্বক হিসেবে খ্যাতি লাভ করলেও পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে তিনি খ্যাতি লাভ করেন নকশাল সন্ত্রাস দমনে। দিলি্লতে তখন ইন্দিরা সরকার ক্ষমতায়। পশ্চিমবঙ্গেও কংগ্রেসী আমল। চারু মজুমদারের সন্ত্রাসী নকশাল আন্দোলন তখন পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম-গঞ্জে, এমনকি বিহার, উড়িষ্যা এবং ত্রিপুরাতেও ছড়িয়ে পড়ছে। কলকাতায় রাজপথে প্রকাশ্য দিনের বেলায় পুলিশ, মিলিশিয়ার সঙ্গে যখন-তখন নকশালদের সশস্ত্র যুদ্ধ চলে। বর্তমানের মাওবাদী সন্ত্রাসের মতো তখন নকশালী সন্ত্রাস অনেকের কাছে অদম্য ও অপ্রতিরোধ্য মনে হয়েছিল।
এ সময় এই নকশাল সন্ত্রাস দমনের পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নে রণজিত গুপ্তের ডাক পড়ে। তিনি নকশাল দমনের জন্য একটি রূপরেখা প্রণয়ন করেন এবং পুলিশ বাহিনী সম্পূর্ণ ঢেলে সাজান। তখন নকশালি হামলায় প্রায়ই পুলিশ নিহত হতো। তিনি এই পুলিশদের জীবন রক্ষার জন্য নিজে যে পরিকল্পনা তৈরি করেন, তাতে অনেক পুলিশের জীবন রক্ষা পায়। তার নাম ভারতের সর্বত্র পরিচিত হয়ে ওঠে।
রণজিত গুপ্ত পুলিশের অধিকর্তা হিসেবে চাকরি করেছেন ৩৫ বছর। পরে অবসর নিয়ে ৩০ বছর তিনি কাটিয়েছেন কৃষি ও নৃতত্ত্ব বিষয়ক গবেষণায়। সক্রিয় ছিলেন গ্রামীণ উন্নয়ন বিষয়ক কাজকর্মে। এ সময়ই ক্ষুদ্রঋণ ও গ্রামীণ ব্যাংক ব্যবস্থার কথা তার মাথায় ঢোকে। তিনি এই ব্যবস্থা সম্পর্কে গবেষণা শুরু করেন এবং 'অমৎধৎরধহ ডবংঃ ইবহমধষ ঃযৎবব ভরবষফ ংঃঁফরবং' নামে একটি বই লেখেন। এই বইতেই তিনি প্রথম গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার আভাস তুলে ধরেন।
রণজিত গুপ্তের মৃত্যুর পর সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার গ্রাম-ভাবনা সম্পর্কে অনেক নিবন্ধ, স্মৃতিকথা প্রকাশিত হচ্ছে। তার একটি লেখা লিখেছেন রণজিত গুপ্তের সহকর্মী এবং ক্রেডিট ওয়াচ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক ড. প্রদীপ হর। তিনি কলকাতার 'দৈনিক স্টেটসম্যান' পত্রিকায় (২৪ মে বৃহস্পতিবার, ২০১২) 'রণজিত গুপ্তের বর্ণময় জীবন' শীর্ষক আলোচনায় গ্রামীণ ব্যাংক ব্যবস্থা সম্পর্কিত রণজিত গুপ্তের রূপকল্পের বিবরণ তুলে ধরেছেন। নিচে তার লেখা থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি।
ড. প্রদীপ হর লিখেছেন, '... সেই সময়কার গ্রামাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নকশালদের মতোই তিনিও বিশ্বাস করতেন গ্রামের বড় ভূস্বামী ও জোতদারদের ক্ষমতা হ্রাসের প্রয়োজনীয়তার কথা। ছোট চাষি এবং বর্গাদারদের নিয়ে ৫০০ থেকে ১০০০ একর জমি নিয়ে সমবায়ভিত্তিক ক্লাস্টার এবং সেখানে গভীর নলকূপ বসিয়ে সেচ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। সে সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে ছোট চাষি ও গরিব পরিবারকে ঋণ জোগান দেওয়ার কথা বলেছিলেন। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর আরও ৩০ বছর তিনি গ্রামীণ উন্নয়ন বিষয়ক কাজকর্ম চালিয়ে গেছেন।
রণজিত গুপ্তের আরেক বন্ধু ও সহকর্মী লিখেছেন, "গ্রামের ছোট চাষিদের উন্নয়ন এবং গরিব পরিবারগুলোকে ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে উৎপাদনশীল কাজে জড়িত করার জন্য তিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছিলেন, নাম দিতে চেয়েছিলেন 'পুওর পিপলস ব্যাংক'। তাতে সরকারের অনুদান থাকবে, কিন্তু যাচাই-বাছাই ছাড়া কোনো বিদেশি ঋণ বা সাহায্য নয়। রণজিত গুপ্ত ভয় করতেন, বিদেশি সাহায্য ও অনুদানের সঙ্গে যে অদৃশ্য তদারকি ও কর্তৃত্বের শিকলটি এই ধরনের ব্যাংক বা সংস্থার গলায় জড়াবে, তা থেকে মুক্ত হওয়া কোনো সময় সম্ভব হবে না; বরং গরিব ঋণগ্রহীতার ঘাড়ে ঋণের বোঝা আরও বাড়বে। তাদের দারিদ্র্য বাড়বে। এ জন্য তিনি সমবায়মূলক ব্যবস্থার ও অভ্যন্তরীণভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের মূলধন সংগ্রহ এবং বিনাসুদে অথবা অল্প সুদে ঋণদানের ব্যবস্থা করা যায় কি-না, সে কথাও চিন্তা-ভাবনা করেছেন।"
রণজিত গুপ্তের পরিকল্পনায় গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা থাকবে গরিব শেয়ারহোল্ডারদের হাতে। তাদের নির্বাচিত বোর্ড ব্যাংক পরিচালনা করবে এবং এই ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে কোনো এক ব্যক্তির কর্তৃত্বের বদলে সরকারের নজরদারি থাকবে। ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররা ব্যাংকের কার্যক্রম ও হিসাব সম্পর্কে অবহিত থাকবেন এবং মুনাফার অংশ পাবেন। 'এই ব্যাংকের কোনো মালিক নেই। মালিকদের শতকরা ৮০ ভাগ নিরক্ষর নারী'_ এই ধরনের চটকদার কথা রণজিত গুপ্ত শোনাননি। নিরক্ষর মহিলারা কেন, নিরক্ষর পুরুষরাও দক্ষতার সঙ্গে ব্যাংক পরিচালনা করতে পারে বা করে এটা শুধু শুভঙ্করের বিরাট ফাঁকি নয়, এ শতকের সবচেয়ে বড় ভাঁওতাও।
নিরক্ষর কিছু নারী ও পুরুষ জুটিয়ে, কোনো ব্যাংক বা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানার প্রলোভন ওদের দেখিয়ে নিজের একক কর্তৃত্বে তা পরিচালনা করা এবং প্রতিষ্ঠানটির সকল সুযোগ-সুবিধা লোটার উদাহরণ গত শতকের ইউরোপেও আছে। সেসব ইতিহাস লিখতে গেলে এই লেখার কলেবর বড় হয়ে যাবে। বারান্তরে সে ইতিহাস লেখা যাবে।
রণজিত গুপ্ত সম্পর্কে তার সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠজনের স্মৃতিচারণা পড়ে মনে হয়, 'নকশাল আন্দোলন দমন করতে গিয়ে তিনি নকশালদের কিছু চিন্তা-ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তার মধ্যে ছোট চাষিদের ভাগ্যোন্নয়ন এবং ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থা করার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা একটি। তিনি পশ্চিমবঙ্গে নকশাল দমনের দায়িত্বে থাকাকালে সরকারের কাছে রিপোর্ট করেছিলেন যে, কেবল সশস্ত্র পন্থায় দমননীতি প্রয়োগ করে নকশাল সমস্যা স্থায়ীভাবে দূর করা যাবে না। পাশাপাশি গ্রামের মানুষের দারিদ্র্য দূর করার জন্য কার্যকর আর্থিক ও সামাজিক কার্যক্রম শুরু করা দরকার। গরিব মানুষের দারিদ্র্য দূর করা ও কর্মসংস্থানের জন্য নকশাল আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রামের জনসাধারণ ও বেকার যুবকদের কাছে এক বিরাট আবেদন সৃষ্টি করেছে। এর চেয়ে উন্নত আবেদন গ্রামের মানুষের কাছে তুলে ধরা দরকার।'
সরকারকে এ কাজে এগোতে না দেখে একজন ব্যক্তি মানুষ হয়েও রণজিত গুপ্ত চাকরি থেকে অবসর নিয়ে নিজেই গরিব মানুষের অভাব দূর করা এবং তাদের ভাগ্যোন্নয়নের পরিকল্পনা তৈরি ও তা বাস্তবায়নের কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। চারদিকে ব্যাপক ও বিরাট পুঁজিবাদী ব্যবস্থার রাহুগ্রাসের মধ্যে অপুঁজিবাদী ব্যবস্থায় একক উদ্যোগে দারিদ্র্য দূর করার আন্দোলন পরিচালনা কতটা অসম্ভব, রণজিত গুপ্ত তা নিজেও বোঝেননি তা নয়, কিন্তু তিনি আমৃত্যু তার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
বর্তমানে পুঁজিবাদী শক্তির একক আধিপত্যের যুগে একটা বিষয় লক্ষণীয়। যখনই জনকল্যাণকর অপুঁজিবাদী কোনো ব্যবস্থা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, পুঁজিবাদ সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধারণ করে নিজের স্বার্থ রক্ষার কাজে লাগায়। ১৯৫৮ সালে আমরা দেখেছি, পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করার জন্য মৌলিক গণতন্ত্র (নধংরপ ফবসড়পৎধপু) নাম দিয়ে আরও আকর্ষণীয় নামের একটি ব্যবস্থা প্রবর্তনের চেষ্টা হয়েছিল। তাও আবার হয়েছিল আইয়ুবের মতো সামরিক শাসকদের দ্বারা।
দেশের সকল মানুষের ভোটাধিকার হরণ করে, তখনকার পাকিস্তানের দুই অংশে ৪০ হাজার করে 'মৌলিক গণতন্ত্রী' সৃষ্টি করে তাদের হাতে ভোটাধিকার সীমাবদ্ধ রেখে বলা হয়েছিল, এটাই আসল বা মৌলিক গণতন্ত্র। এই মৌলিক গণতন্ত্রীদের নানা সুযোগ-সুবিধা, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অঢেল টাকা গছিয়ে দিয়ে তাদের সকলকেই ক্ষমতাসীনদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছিল। কর্তাদের হুকুমের বাইরে তাদের নড়াচড়ারও উপায় ছিল না। বিচারপতি কায়ানি তাই বিদ্রূপ করে বলেছিলেন, 'নধংরপ ফবসড়পৎধপু_ হবরঃযবৎ নধংরপ, হড়ৎ ফবসড়পৎধপু' (মৌলিক গণতন্ত্র মৌলিক নয়, গণতন্ত্রও নয়)।
বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংক ব্যবস্থা সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। ওঃ রং হবরঃযবৎ ৎঁৎধষ, হড়ৎ ধ নধহশ, এটা গ্রামীণ নয়, ব্যাংকও নয়। এর আদি উদ্ভাবকরা যে মহৎ উদ্দেশ্যে ক্ষুদ্রঋণ, গ্রামীণ ব্যাংক বা গরিবের ব্যাংক ইত্যাদি পরিকল্পনার কথা ভেবেছিলেন, তা গ্গ্নোবাল ক্যাপিটালিজমের হাতে হাইজ্যাক হয়ে গেছে বহু আগে। এখন নিজেদের বাছাই করা একদল নিরক্ষর মহিলাকে ব্যাংকের মালিক হওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে, মুনাফার অংশ পাওয়ার অধিকারবিহীন শেয়ার গছিয়ে দিয়ে ব্যক্তিবিশেষের অঘোষিত মালিকানার কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে, পুঁজিবাদী বিশ্বেও তার তুলনা বিরল। চড়া সুদে দেওয়া এই ক্ষুদ্রঋণের শোষণ ও লুণ্ঠনের প্রক্রিয়াটি বড় নির্মম।
এই ব্যক্তি-স্বেচ্ছাচারিতারই নাম দেওয়া হয়েছে গরিবের মালিকানা। দেশের সরকারও এ ব্যাপারে কোনো অনিয়ম হচ্ছে কি-না তা দেখতে চাইলে চিৎকার শুরু হয় গরিবের মালিকানা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। বেচারা গরিবরা জানে না তাদের মালিকানার চেহারাটা কী? তারা হুকুম পালনে অভ্যস্ত।
পশ্চিমবঙ্গে রণজিত গুপ্তের গ্রামীণ ব্যাংক বা গরিবের ব্যাংকের রূপরেখা যে বাংলাদেশের চেয়ে আলাদা, তা তার এই ঋণদান সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো পড়লেই বোঝা যায়। গরিবের নামে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে তিনি নিজে সওদাগিরি করতে চাননি। পশ্চিমবঙ্গে ৩০ বছরের কমিউনিস্ট জমানাতেই যখন তার পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হয়নি, তখন ভবিষ্যতে হবে কি-না সন্দেহ। হলে ভালো হতো। বাংলাদেশের মানুষের চোখ খুলত।
লন্ডন, ১৫ জুন ২০১২, শুক্রবার

বৃহস্পতিবার, ১৪ জুন, ২০১২

নতুন করে রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টির উদ্দেশ্য কি?



 আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী  
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যাটি বাংলাদেশের নিজস্ব সমস্যা নয়, এটি প্রতিবেশী মিয়ানমারের সমস্যা। সেখানে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের উপর, যারা ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান, অত্যাচার শুরু হওয়ায় এবং তারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হওয়ায় নিরাপদ আশ্রয় লাভের জন্য বাংলাদেশের সীমান্তে ঢুকে পড়ছে। সমস্যাটি আজকের নয়। বহু বছর আগেও ৫ লাখের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে ঢুকেছিলো। সম্ভবত: বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে তাদের সংখ্যা এখন ২৫ হাজারের মতো। বাকি অনেকেই নানাভাবে বাংলাদেশের জনজীবনে মিশে গেছে। বাংলাদেশের পাসপোর্ট সংগ্রহ করে বিদেশে চলে গেছে। এরা বাংলাদেশের সমাজ জীবনে রাজনৈতিক এবং সামাজিক দু’ ধরনের উত্পাতই সৃষ্টি করেছিল। যে উত্পাত  থেকে বাংলাদেশ এখনো মুক্ত হয়নি। বিপন্ন শরণার্থীদের আশ্রয় ও নিরাপত্তা দেয়া মানবতার দাবি। বাংলাদেশ নিজস্ব আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যায় বিব্রত থাকায় এবং এক বিরাট সংখ্যক আটকে পড়া পাকিস্তানির (বিহারি) সমস্যার বেড়াজাল থেকে এখনো সম্পূর্ণ মুক্ত হতে না পারায় নতুন করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়দানের গুরুতর চাপ বহন করা তার পক্ষে অসম্ভব। কয়েক লাখ আটকে পড়া পাকিস্তানির সমস্যা থেকে মুক্ত হওয়ার আগেই আবার কয়েক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর চাপ বহন করা বাংলাদেশের দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য ছিলো কষ্টকর।
তথাপি মিয়ানমারের রাখাইন বা আরাকান অঞ্চলের  রোহিঙ্গা পরিচয়ধারী মুসলমানেরা আগেও যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হয়ে দলে দলে সীমান্ত পেরিয়ে ঢোকে তখন তাদের আশ্রয় দিতে বাংলাদেশ বাধ্য হয়েছিলো। অনেকেরই ধারণা, মিয়ামনারের সামরিক জান্তা দেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বিভক্তি সৃষ্টির জন্য বৌদ্ধ ও মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ উস্কে দিয়ে এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত করেছিলো। এই ধারণাটির সত্যতা প্রমাণিত হয় বর্তমানে দাঙ্গা আবার শুরু হওয়ায় মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের উক্তি থেকে। বহির্বিশ্বের চাপে এবং দেশের ভেতরে গণতান্ত্রিক আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠায় অং সান সূ চিকে মুক্তি দিয়ে পার্লামেন্টে যোগদানের সুযোগ দিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে বাধ্য হওয়ার পর সামরিক জান্তা সেই প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার জন্য এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করবে বৈকি। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, “এই দাঙ্গা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়ার কাজকে ব্যাহত করবে।”
তাই যদি হয়, সামরিক জান্তা এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কঠোর হাতে বন্ধ করার ব্যবস্থা করছেন না কেন? খবরে জানা যায়, মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের সহায়তাতেই রোহিঙ্গারা আবার বাংলাদেশে ঢুকছে। তা থেকে কি এই সন্দেহই দৃঢ় হয় না যে, নিজ দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করা এবং বাংলাদেশে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির লক্ষ্যে মিয়ানমারের শাসক সামরিক জান্তা এই নতুন শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টি করতে চাইছেন?
ইতিপূর্বেও তারা এই সমস্যা সৃষ্টি করেছেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার রোহিঙ্গাদের কোনো প্রকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে বাংলাদেশে পালাতে তাদের বাধ্য করেছিলেন। বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়েছে। এটা দুর্গত মানবতার প্রতি প্রতিবেশীসুলভ দায়িত্ব পালন। কিন্তু তারপরই শুরু হয়েছে বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে এক ভয়াবহ অস্থিরতা। রোহিঙ্গা যুবক-যুবতীরা দেশে ফিরে যেতে না পেরে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে নানা প্রকার সামাজিক অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে বাংলাদেশের জামায়াত সংশ্লিষ্ট জঙ্গি গ্রুপগুলো এই রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে তাদের ক্যাডার সংগ্রহ শুরু করে। ফলে রোহিঙ্গা সমস্যায় বাংলাদেশের জন্যও এক বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকার এই পরিস্থিতি সামাল দিয়ে উঠতে না উঠতেই আবার মিয়ানমারে নতুন করে রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টি করা হয়েছে। এবারের হাসিনা সরকার শরণার্থী সমস্যায় একটা নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের গ্রহণে অসম্মতি জানিয়েছেন। এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের আর কিছুই করার নেই। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সামাজিক ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন দ্বারা অশুভ উদ্দেশ্য সাধনের কাজে লাগাবার জন্য একাধিক অশুভ মহল যে  চক্রান্তের জাল বিস্তার করেছিলো, তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দিলে বাংলাদেশ চরম সর্বনাশের সম্মুখীন হবে।
এই কথাটি জানা থাকা সত্ত্বেও জাতিসংঘের শরণার্থী সংক্রান্ত হাইকমিশন বাংলাদেশকে নতুন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছেন। বাংলাদেশ সরকার দৃঢ়তার সঙ্গে তাতে অসম্মতি জানিয়ে ভালো করেছেন। একটি নৈতিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজের দেশের ভেতরে যে বিপজ্জনক সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হতো সেটি হাসিনা সরকার ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছেন। জাতিসংঘের শরণার্থী হাইকমিশনের উচিত মিয়ানমারের সামরিক জান্তার উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা, যাতে তারা এই শরণার্থী সমস্যাকে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজকে বিলম্বিত করার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে। অন্যদিকে এই শরণার্থীদের অবিলম্বে দেশে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ দিয়ে আর্তমানবতার প্রতি দায়িত্ব পালন করে। বাংলাদেশের ন্যূব্জ ঘাড়ে এই বোঝা চাপানো জাতিসংঘের উচিত নয়।
অতীতে দুই দুইবার বাংলাদেশের ঘাড়ে এই শরণার্থী সমস্যার বোঝা রাজনৈতিক অশুভ উদ্দেশ্যে চাপানো হয়েছে। দুই দুইবারই বিপন্ন মানবতা রক্ষা ও অত্যাচারিত মুসলমানদের রক্ষার ধুয়া তোলা হয়েছে। অধিকাংশ সময় দেখা গেছে, শাসক শক্তির প্রশ্রয় ও মদদ এবং অশুভ উদ্দেশ্য ছাড়া সাম্প্রদায়িক বিরোধ কখনো মাথাচাড়া দিতে পারে না। ভারতের গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরপশু নরেন মোদীর প্রত্যক্ষ মদদ ছাড়া এমন নৃশংস মুসলমান নিধনযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হতে পারতো না। একথা আজ ওপেন সিক্রেট। মিয়ানমারেও রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টির মূলে ছোটখাটো অনেক কারণ ছিলো। কিন্তু বড় কারণই ছিলো, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বিভক্তি সৃষ্টির জন্য ইয়াঙ্গুনের সামরিক জান্তার চক্রান্ত।
তাদের চক্রান্তের সঙ্গে আবার বাংলাদেশের জিয়াউর রহমানের সরকার এবং পরবর্তীকালের খালেদা জিয়ার সরকারের উদ্দেশ্য সম্ভবত  মিলে গেছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রথম দফা বাংলাদেশে আগমন ঘটে ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে। দ্বিতীয় দফা আগমন করে ১৯৯২ সালে খালেদা জিয়ার আমলে। বিপন্ন ইসলাম এবং আক্রান্ত মুসলমানদের রক্ষার নামে এই রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে ঘাঁটি গাড়তে দেওয়া হয়। এদের  যথাসময়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা না করে বাংলাদেশের জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো বিশেষ করে জামায়াতকে এদের মধ্য থেকে ক্যাডার সংগ্রহের সুযোগ দেওয়া হয়।
অনেক রোহিঙ্গা যুবক বাংলাদেশে আসতে ইচ্ছুক ছিলো না। তাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠিয়ে চাকরি পাওয়ার বিরাট প্রলোভন দেখিয়েও নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী এক বিরাট সংখ্যক রোহিঙ্গা এখন সউদি আরবে। তাদের অনেকের সামাজিক অপরাধ ও দুষ্কর্মের দায় ও দায়িত্ব বাংলাদেশের ঘাড়ে বর্তায়। হাসিনা সরকারের সামনে এখন বিরাট সমস্যা, এদের আশ্রয় না দিলে আর্ত-মানবতা ও বিপন্ন মুসলমানদের এই  সরকার রক্ষা করছে না বলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শ্লোগান তোলা হবে। অন্যদিকে এই শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া হলে বাংলাদেশে যে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হবে তার সুযোগ নেবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিরোধী অশুভ চক্রগুলো- এমনকি ইসলামের লেবাসধারী জঙ্গিরাও।
এই অবস্থায় বাংলাদেশে আবার রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টির পুরনো খেলার পুনরাবৃত্তি ঘটতে না দিয়ে এবং কঠোর মনোভাব নিয়ে হাসিনা সরকার অত্যন্ত প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। অবশ্যই মিয়ানমারের এক বিপুল জনগোষ্ঠীকে সাম্প্রদায়িকতার দানবের তান্ডব থেকে রক্ষার মানবিক দায়িত্বটির প্রশ্নও এখানে জড়িত। এই ব্যাপারে দায়িত্ব পালনের জন্য জাতিসংঘ শরণার্থী হাইকমিশনকে মিয়ানমারের উপর কঠোর চাপ দিতে হবে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের বাসিন্দা এবং তাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নেওয়া এবং নিরাপদ পুনর্বাসনের দায়িত্ব মিয়ানমার সরকারের। এই দায়িত্ব যাতে তারা পালন করে, সে জন্যে দেশটির সরকারের উপর কঠোর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে। বাংলাদেশের দরোজা এই শরণার্থীদের জন্য বার বার খুলে দেওয়া এই সমস্যা সমাধানের সঠিক পথ নয়। খুলে দিলে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এবং বাংলাদেশের জঙ্গি ও অশুভ রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর অশুভ উদ্দেশ্য পূরণের কাজেই সাহায্য জোগানো হবে, যা হবে বাংলাদেশের নিজের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক।
লন্ডন ১৪ জুন, বৃহস্পতিবার, ২০১২

বুধবার, ১৩ জুন, ২০১২

‘বহ্বাড়ম্বরে লঘুক্রিয়া’

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী


যাক, এগারোই জুন তারিখটি বাংলাদেশে ভালয় ভালয় কেটে গেছে। সরকারকে দাবি মেনে নেওয়ার আলটিমেন্টাম দেওয়ার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর বিএনপি যে বিক্ষোভ মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছিল তাতে এবার তেমন কোন জ্বালাও পোড়াওর ঘটনা ঘটেনি। কোন নিরীহ রিকশাঅলা বা ঘুমন্ত বাস ড্রাইভারকে আগুনে পুড়ে মরতে হয়নি। বিএনপি ইচ্ছে করে এটা করেনি তা নয়। এবার করার ক্ষমতা ছিল না। যারা এটা ঘটাবেন, তাদের পালের গোঁদারা এখন জেলে। বাংলাদেশের রাজনীতি যারা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেন, আমার তেমন এক বন্ধু বলেছেন, ‘কয়েকজন নেতা গ্রেফতার হলেই যে দলের আন্দোলন করার ক্ষমতা থাকে না, তাদের ভবিষ্যত কোথায়?’ 
আন্দোলনের ক্ষমতা না থাকলেও বিএনপি আস্ফালন করার ক্ষমতা হারায়নি। এগারোই জুনের মহাসমাবেশেও স্বয়ং নেত্রী স্বভাবসুলভ তর্জন গর্জন করেছেন এবং বলেছেন, সামনে পবিত্র রমজান মাস, এ সময় হরতালসহ আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচী দেওয়া হলে জনগণের কষ্ট হবে, সেজন্য রমজানের পর কঠোর কর্মসূচী নিয়ে তিনি আবির্ভূত হবেন। জনগণের কষ্টের কথা ভেবে বেগম জিয়ার হৃদয় মায়ের হৃদয়ের চাইতেও বেশি উদ্বেলিত, একথা জেনে আমার মতো অনেকেই মজা পাবেন। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, “মায়ের চাইতে যার দরদ বেশি তার নাম ডাইনী।” বাংলাদেশে এই ‘ডাইনী-রাজনীতি’র খেলা সাধারণ মানুষ অনেক দেখেছে। সুতরাং এখন এই কপটদরদে তাদের মন গলবে না। বিএনপির আন্দোলন মানেই যে ভাঙচুর, জ্বালাও পোড়াও এবং নিরীহ মানুষ হত্যা একথাটা এখন সর্বজনবিদিত।
অথচ বর্তমান সরকারের গত সাড়ে তিন বছরের ব্যর্থতা পানি, গ্যাস, বিদ্যুত, যানজট, গুম, হত্যা, সন্ত্রাস ইত্যাদি নিয়ে বিএনপি চাইলে একটি সুষ্ঠু, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারত। এজন্য প্রথমেই তাদের দরকার ছিল সংসদে যোগদান। ব্রুট মেজরিটির অধিকারী ক্ষমতাসীন সরকার সংসদে তাদের কথা শুনত না, তাতে কি? সাংসদ হিসেবে বিরোধীদলীয় নেতারাও বেতন ভাতা খান, অন্তত সেটা হালাল করার জন্য জনপ্রতিনিধিত্বের ভূমিকা পালনে সংসদের ভিতরে তাদের সোচ্চার হওয়া উচিত ছিল। সেই সঙ্গে সংসদের বাইরেও জনসমর্থনপুষ্ট আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করা। তাতে শুধু শহুরে নাগরিকেরা নন, গ্রামের মানুষও ধীরে ধীরে এসে বিরোধী দলের আন্দোলনের ছাতার নিচে জমায়েত হতো। 
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বা সরকার যতই বলুন, তারা গ্রামবাংলায় জনপ্রিয় এবং কৃষি ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য বিরাট; এই দাবি এক শ’ ভাগ ধোপে টেকে না। কৃষির বাম্পার ফলন হয়েছে বটে, কিন্তু কৃষক চাল বা ধান বেচে উৎপাদন খরচাও তুলতে পারে না। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষা ক্ষেত্রে একটি অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন, তিনি বিনামূল্যে স্কুল মাদ্রাসার সকল শিক্ষার্থীর হাতে পাঠ্যপুস্তক তুলে দিয়েছেন। কিন্তু দেশের বিরাট সংখ্যক প্রাথমিক স্কুলঘরের খড়ের চালাও নেই। রোদ বৃষ্টি মাথায় শিশুদের খোলা আকাশের নিচে বসে লেখাপড়া করতে হয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় যত নরনারীর মৃত্যু হয়, পাকিস্তানে ন্যাটোর ড্রোন হামলাতেও তত লোকের মৃত্যু হয় কিনা সন্দেহ। ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার পেছনে না হয় রাজনৈতিক রহস্য রয়েছে ধরে নিলাম। কিন্তু সাগর-রুনির হত্যাকা-ের কিনারা এত দীর্ঘদিনেও যদি পুলিশ-র‌্যাব, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো করতে না পারে, তাহলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার গদিতে কি করে এখনো বহাল থাকেন?
ফিরিস্তি বাড়াবো না। দেশে আন্দোলন করার মতো ইস্যুর অন্ত নেই। বিএনপি এসব ইস্যুর কথা মুখে বলে। কিন্তু তাদের আন্দোলনের আসল ইস্যু এসব নয়। ক্ষমতা হারানোর পর কিছুদিন নিশ্চুপ ও নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকতে বাধ্য হওয়ার শেষে খালেদা জিয়া আবার যখন রাজনীতিতে সক্রিয় হলেন, তখন থেকেই তার তথাকথিত আন্দোলনের মূল লক্ষ্য বিভিন্ন দুর্নীতির মামলা থেকে নিজেকে এবং বিভিন্ন দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের মামলা থেকে পুত্র তারেক রহমানকে বাঁচানো। এই ইস্যুটির সঙ্গে পরে যুক্ত হয়েছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তিদানের চেষ্টা বানচাল করা।
দেশের সচেতন মানুষের কাছে এটা এখন খুবই স্পষ্ট যে, তাদের দাবি-দাওয়া দুঃখ কষ্ট সমস্যা বিএনপির কাছে মুখ্য বিষয় নয়। তারা জনগণের দুঃখ কষ্ট দাবি-দাওয়া নিয়ে জনগণকে সাথে করে আন্দোলনে নামতে মোটেই আগ্রহী নয়। তারা মাঠে নামার সময় মুখে এই ইস্যুগুলোর কথা বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করেন দলে টানার জন্য। তাদের আসল ইস্যু তারেক বাঁচাও, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাও এবং বর্তমান সরকারকে মেয়াদ শেষ করতে না দিয়ে ক্ষমতা থেকে টেনে নামাও। এই ইস্যুগুলোর সঙ্গে বর্তমানে আরেকটি ইস্যু যোগ হয়েছে, ড. ইউনূসকে বাঁচাও (গ্রামীণ ব্যাংক সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের তদন্ত থেকে)।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের প্রধান কর্মসূচী ছিল বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচার ঠেকানো এবং শাস্তি থেকে তাদের বাঁচিয়ে জেল থেকে বের করতে না পারলেও সেখানে তাদের ফাইভস্টার হোটেলের আরাম আয়েশে রাখা। শেষ পর্যন্ত সেই চেষ্টা তাদের সফল হয়নি। এখন বিরোধী দল হিসেবে থাকা অবস্থায় তাদের দ্বিতীয় প্রধান লক্ষ্য ’৭১-এর নারীঘাতী শিশুঘাতী বর্বর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানো। হালে আবার ‘ইউনূস বাঁচাও’ কর্মসূচী তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
ফলে জনসমর্থন পুষ্ট আন্দোলন বিএনপি তৈরি করতে পারছে না। দেশের মানুষ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে বা ড. ইউনূসকে বাঁচাতে রাজপথে আন্দোলনে নামতে উৎসাহী নয়। বিএনপিকে তাই আন্দোলন করার বদলে আরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টায় নামতে হয়েছে। হাসিনা সরকারও বুঝে শুনেই হার্ডলাইনে গেছেন। কথায় বলে ‘যেমন কুকুর, তেমন মুগুর’। প্রবাদটা আমরা না চাইলেও বাংলাদেশে এবার ফলে গেছে। ১১ জুন বিএনপিকে ‘নিরামিষ মহাসমাবেশের’ মধ্যেই দায়িত্ব পালন শেষ করতে হয়েছে।
বিএনপির বর্তমান ধারাবাহিক আন্দোলনের মূল লক্ষ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় এবং তাদের ধৃত নেতাদের মুক্তি অর্জন করা নয়; লক্ষ্য সন্ত্রাস-দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত তারেক রহমানের বিচার ও শাস্তি ঠেকানো এবং তাকে গলায় মালা দিয়ে দেশে ফিরিয়ে এনে একেবারে ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা করা। তার প্রমাণ মেলে গত ১১ জুনের সমাবেশে বিএনপির অধিকাংশ কর্মী, ভাড়াটিয়া কর্মীর টি শার্টের ছবিতে। শার্টের দুই পকেটের একটিতে জেনারেল জিয়া এবং অন্যটিতে খালেদা জিয়ার ছবি ছোট করে ছাপা। কিন্তু মাঝখানে বিশাল করে তারেক রহমানের ছবি। ‘বাঁশের চাইতে কঞ্চি দড়’ এই প্রবাদটি যে অসত্য নয়, মহাসমাবেশের মহাকর্মীদের বুকে টিশার্টের ছবি দেখে তা বোঝা যায়।
বিএনপির আন্দোলনের আসল কর্মসূচীতে যে এখন ‘ইউনূস-বাঁচাও’ ইস্যু অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তা বোঝা যায় তাদের কথাবার্তা শুনলে এবং কাজ কারবার দেখলেই। গ্রামীণ ব্যাংকে নানা অনিয়মের অভিযোগে এবং শীর্ষ পদে থাকার মেয়াদ শেষ হওয়ায় ড. ইউনুসকে সরকার ব্যাংকের প্রধানের দায়িত্ব পালন থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। সরকারী অর্থসাহায্যে প্রতিষ্ঠিত একটি ব্যাংক সম্পর্কে এই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ সরকারের এখতিয়ারভুক্ত। সরকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ড. ইউনূস সুপ্রিমকোর্টে মামলা করেছিলেন, তাতেও তিনি হেরেছেন। এখন তিনি দেশী বিদেশী চাপ সৃষ্টি দ্বারা সরকারকে কাবু করে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্তৃত্ব আবার ফিরে পেতে চাইছেন। তার সম্ভবত ভয়, গ্রামীণ ব্যাংকের চৌত্রিশ বছরের কার্যকলাপ সম্পর্কে সরকার যে তদন্ত কমিশন নিযুক্ত করেছে, সেই তদন্তে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসতে পারে।
ড. ইউনূস যদি গ্রামীণ ব্যাংকে তার চৌত্রিশ বছরের একচ্ছত্র রাজত্বকালে কোন অন্যায় অনিয়ম না করে থাকেন, তাহলে তো এই তদন্তে তার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এখন প্রশ্ন, তিনি এই তদন্তে (যা এখনো আরম্ভ হয়নি) এত ভয় পেয়েছেন কেন এবং এই তদন্ত বন্ধ করার জন্য এত ডেসপারেট হয়ে উঠেছেন কেন? এখানেও এই তদন্ত কমিশনের কাজ বন্ধ করার জন্য ড. ইউনূসের দাবির সমর্থনে এগিয়ে এসেছে বিএনপি। তারা একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে চায় এবং গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কিত তদন্ত কমিশনের কাজও বন্ধ করতে চায়। এ দুয়ের মাঝে যোগসাজশটা কি?
গ্রামীণ ব্যাংক সংক্রান্ত প্রস্তাবিত তদন্ত কমিশনের কাজ বন্ধ করানোর জন্য ড. ইউনূস যে কতটা ডেসপারেট, তা বোঝা যায় গত ৩১ মে ঢাকার একাধিক দৈনিকে এই তদন্ত বাতিল করার দাবিতে তিনি নিজে একটি প্রবন্ধ লিখেই ভীতিমুক্ত হননি। দেশের মুখচেনা কিছু সংখ্যক সাংবাদিক ও কলামিস্ট দ্বারা এই ব্যাপারে একটা ক্যাম্পেন সৃষ্টিরও চেষ্টা চালাচ্ছেন। এই ক্যাম্পেনারদের অধিকাংশই হয় বিএনপি-সমর্থক না হয় বিএনপি-ঘেঁষা। 
সর্বশেষ, এই ক্যাম্পেনের অংশ হিসেবেই হয়ত গ্রামীণ ব্যাংক সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের কাজ বন্ধ করার দাবিতে বিএনপির বলয়ের কয়েকজন সাংবাদিক ও কলামিস্টের একটি যুক্ত বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। এই বিবৃতিতে যাঁরা সই করেছেন তাঁদের নাম দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। সাদেক খান থেকে শুরু করে যে ক’জনের নাম বিবৃতিতে রয়েছে। তাঁরা সকলেই বিএনপি-ঘেঁষা সি ক্যাটাগরির সাংবাদিক ও কলামিস্ট। এ ও বি ক্যাটাগরির বিএনপি-ঘেঁষা সাংবাদিক ও কলামিস্টরা কোথায় গেলেন? এমনকি ড. ইউনূসের প্রধান খলিফা হিসেবে পরিচিত ‘নিরপেক্ষ’ বাংলা ও ইংরেজী দৈনিক দুটির সম্পাদকের স্বাক্ষরও এই বিবৃতিতে নেই। তাহলে কি ড. ইউনূস এখন এতই অসহায় যে তাকে সমর্থন কুড়াতে সমাজের তলানি পর্যন্ত নামতে হবে?
বিএনপি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। কিন্তু দেশের জনগণের আসল সমস্যা নিয়ে আন্দোলনে না নেমে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা, তারেক বাঁচাও, ইউনূস বাঁচাও ইত্যাদি বিষয়কে ইস্যু করে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে তারা ক্ষমতায় যেতে পাববেন কি? আমার সন্দেহ আছে। আওয়ামী লীগ যদি নিজেদের ব্যর্থতাগুলো না শুধরে নিজেরাই হারিকিরির পথ বেছে না নেন, তাহলে আগামীতে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার দিবাস্বপ্ন সফল হবে না। আর তারেক রহমানের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া? মানব সভ্যতার ইতিহাসের এই নিদারুণ দুর্ঘটনাটি বাংলাদেশে ঘটবে বলে আমি মনে করি না। 

লন্ডন ॥ মঙ্গলবার, ১২ জুন ২০১২

মঙ্গলবার, ১২ জুন, ২০১২

আন্দোলন কেন বারবার ব্যর্থ আস্ফালনে পরিণত হচ্ছে?

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী


এগারোই জুন সোমবার এই লেখাটা লিখতে বসেছি। আজ বাংলাদেশে বিএনপির বহু বিঘোষিত বিক্ষোভ প্রদর্শন ও জনসমাবেশ দিবস। ১২ জুন মঙ্গলবার সকালে আমার এ লেখাটি যখন পাঠকদের চোখে পড়বে, তখন তাঁরা জেনে যাবেন, বিএনপি তার সরকারবিরোধী আন্দোলনের কতটা সূচনা করতে পারছে, নাকি তা আবার ব্যর্থ আস্ফালনে পরিণত হয়েছে। সাধারণত বিএনপি যেদিন হরতাল বা বিক্ষোভ সমাবেশ ডাকে, তার আগের রাতেই কিছু বাস, গাড়ি পুড়িয়ে এবং নিরীহ বাস ড্রাইভার বা রিকশাওয়ালাকে পুড়িয়ে মেরে তাদের শক্তির আগাম মহড়া দেয়।
এবার সেই মহড়া দেখা যায়নি। এই লেখাটি শুরু করার সময় পর্যন্ত, অর্থাৎ ১১ জুন ঢাকার সময় দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঢাকা বা দেশের অন্য কোথাও গোলযোগের খবর পাইনি। তবে বিকেলে যখন মিছিল-সমাবেশ হবে, তখন কিছু গোলযোগ হতেই পারে। সরকার বিএনপি অফিসের সামনে এ সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে। তবে জননিরাপত্তার জন্য কিছু কঠোর ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছে। তাতে মনে হয়, মফস্বলের কথা বলতে পারি না, তবে ঢাকায় কোনো বড় ধরনের গোলযোগ হবে না। হলে অন্য কথা।
১১ জুন সকালে (লন্ডন সময়) এক ঢাকাইয়া বন্ধুকে শহরের খবর জানার জন্য টেলিফোন করেছিলাম। তিনি শিক্ষিত মানুষ। কিন্তু ঢাকাইয়া বাংলায় আমাকে বললেন, 'ছালায় (শালায়) হাঙ্গামা করার আদমি কই, সবাই তো ফাটকে বন্দি। ইট-পাটকেল মারার মানুষ ত ভাড়া করার ছুযোগ তারা পায় নাই।' তাঁর কথায় খুব একটা আশ্বস্ত হইনি। সরকারের দমননীতির মুখে বিএনপি এখন গর্তে লুকালেও জামায়াত গর্তে লুকায়নি। পালের গোদারা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত হয়ে জেলে থাকায় তাদের আন্দোলন করার শক্তি খর্ব হলেও খুন-জখম, জ্বালাও-পোড়াওয়ের দক্ষতা নষ্ট হয়নি। মনে হয়, আপাতত তারা যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজি বদলাতে বাধ্য হয়েছে।
১০ জুন সরকারকে দেওয়া বিএনপির চরমপত্রের মেয়াদ শেষ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিসহ দলটির আরো কিছু দাবি এই তারিখের মধ্যে মেনে নেওয়া না হলে তার পরই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার যুদ্ধের দামামা বাজানো হবে বলা হয়েছিল। তবে এ দামামা এবার জোরেশোরে বাজেনি। কারণ দামামা বাজানোর জন্য, গর্জন-সেনাপতি হিসেবে বিএনপির মির্জা ফখরুলসহ যে নেতারা খ্যাত তাঁরা এখন জেলে। এমনকি বাজখাঁই গলার অধিকারী সাকা চৌধুরীও জেলে। কিছুদিন জেলের ভাত খাওয়ার পর তাঁরও বিক্রম কমে এসেছে মনে হয়। তিনি জানিয়েছেন, তাঁকে বিচার চলাকালে জামিনে মুক্তি দিলে তিনি খালেদা জিয়া ও দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে সংসদ অধিবেশনে যোগ দেবেন (হায় রে খাঁচাবন্দি কেঁদো বাঘ!)।
সরকার বিরোধী দলের আলটিমেটাম বা চরমপত্র অগ্রাহ্য করেছে। একেবারে অগ্রাহ্য করত না, যদি তারা জানত বিএনপির আন্দোলন করার তাগদ আছে। গাড়ি পোড়ানো বা বাস ড্রাইভার, রিকশাচালক হত্যা তো আন্দোলন নয়। আন্দোলন হচ্ছে জনসমর্থনের জোরে সারা দেশ অচল করে দেওয়া। বিএনপি কোনো দিন তা পারেনি, কোনো দিন পারবে না। তারা যেটা পারে সেটা হচ্ছে, অসারের তর্জন-গর্জন। এই তর্জন-গর্জনে দলের নেত্রী থেকে শুরু করে পাতি নেতারা পর্যন্ত কতটা দড় তার প্রমাণ দেশের মানুষ বহুবার পেয়েছে।
এ সম্পর্কে আমার বন্ধু মোনায়েম সরকার একটি মজার কথা বলেন। তিনি বলেন, 'বিএনপি তো আন্দোলনের গ্রামারই (ব্যাকরণ) জানে না। তারা আন্দোলন করবে কি? ডোবায় জন্ম ব্যাঙাচি, বড়জোর ব্যাঙ হতে পারে। লাফ দিতে জানে, হাঁটতে জানে না। সেনা ছাউনিতে জন্ম বিএনপিরও আজ একই অবস্থা। আওয়ামী লীগকে অনুকরণ করে আন্দোলন করতে চায়। কিন্তু সেটা আন্দোলন হয় না। হয় ব্যর্থ আস্ফালন। বারবার এই ব্যর্থ আস্ফালনের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। আন্দোলন আর হচ্ছে না।
১১ জুনও তাই বড় কিছু হচ্ছে বা হবে, তা আমার মনে হয় না। বিকেলের দিকের সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল থেকে কিছু গোলযোগ হতে পারে, পুলিশের সঙ্গে লাঠালাঠি হতে পারে, তার বড় কিছু নয়। যেটা হবে, সমাবেশে দাঁড়িয়ে আবার বিএনপি নেত্রী ও অন্যান্য নেতার আস্ফালন। বর্তমান সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে সামনের ৪০ বছরেও আর ক্ষমতায় আসতে না দেওয়ার হুমকি। আরো কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণা ইত্যাদি ইত্যাদি। দেশে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে হরতালবিরোধী যে মনোভাব, তাতে বুদ্ধিমান হলে বিএনপি নেতারা আর হরতালের ডাক দেবেন না। দিলে নিজেদের নাক তাঁরা নিজেরাই কাটবেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি কথা ভালোভাবেই বুঝে গেছেন, বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবির পেছনে কোনো আন্তরিকতা নেই। এই দাবি নিয়ে তারা যে হৈচৈ করছে, তার মূল উদ্দেশ্য, নির্বাচনে তারা হেরে যাবে- এটা বুঝতে পারলে তাতে অংশগ্রহণ না করার একটা পথ খোলা রাখা। এ ব্যবস্থাকে বিএনপিই ইয়াজউদ্দিনের প্রেসিডেন্টগিরির আমলে এমন বর্জ্য জাতীয় ব্যবস্থায় পরিণত করে গেছে যে এটি এখন একটি পচা আম। দুর্গন্ধ ছাড়া এ ব্যবস্থায় এখন আর কিছু নেই। এই ব্যর্থ ও দূষিত ব্যবস্থাকে পুনর্বহাল করে দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা যাবে কি? ১৯৯৬ সালে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। খালেদা জিয়া সেই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে মানতে চেয়েছিলেন কি? এখন তিনি কোন মুখে বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে না?
বর্তমানে বিএনপির শত ডাকেও যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন হচ্ছে না, তার বড় কারণ জনগণ এ ব্যবস্থার মাজেজা বুঝে গেছে। তারা আর পচা আমের খোসায় পা পিছলাতে রাজি নয়। তাই বিএনপি নেত্রীর এত আস্ফালন, সরকারকে আলটিমেটাম ইত্যাদি সত্ত্বেও এ দাবির পেছনে জনসমর্থন জড়ো করা যাচ্ছে না। দেশের মানুষ দেখতে চায় একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, তা যে ব্যবস্থার অধীনেই অনুষ্ঠিত হোক না কেন।
তথাপি আগামী নির্বাচনকে সব বিতর্কের উর্ধ্বে রাখা এবং সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনের আগে এক ধরনের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়টি বিবেচনা করে দেখতে পারে। ১৯৪৬ সালে ভারত ভাগের আগে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ মিলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার (Interim Government) গঠিত হয়েছিল, যে সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন কংগ্রেস থেকে নেহরু এবং মুসলিম লীগ থেকে অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন লিয়াকত আলী। অনুরূপভাবে বর্তমান বাংলাদেশে একটি নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী মন্ত্রিসভা গঠিত হতে পারে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। খালেদা জিয়া ও জেনারেল এরশাদ ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী হবেন। মহাজোট ও ১৮ দলীয় জোট থেকে অন্যান্য মন্ত্রী গ্রহণ করা হবে। সংসদের বাইরেই এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন নিয়ে সর্বদলীয় ভিত্তিতে আলোচনা হতে পারে। ঐকমত্যে পৌঁছলে তা সংসদে সর্বসম্মতভাবে পাস করালেই হবে। তবে আমার আশঙ্কা, আওয়ামী লীগ তার সব আন্তরিকতাসহ এ ধরনের প্রস্তাব নিয়ে এগোলেও বিএনপি তাতে সাড়া দেবে না। তাদের কথা 'সালিস মানি, তালগাছটা চাই।'
আমার অনেক বন্ধুর ধারণা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবির পেছনে যথেষ্ট জনসমর্থন আছে। আমার তা মনে হয় না। দেশের মিডিয়াগুলোর লেখালেখি বা টেলিভিশনের টক শো দেখে যাঁরা এ কথা ভাবেন, তাঁরা বৃহৎ পল্লীবাংলার নাড়ির স্পন্দন জানেন না। বিএনপির এ দাবিতে শহুরে মধ্যবিত্তদের বিলাসী সমর্থন রয়েছে। গ্রামের মানুষ এ ব্যবস্থা নিয়ে মাথা ঘামায় না। ১৯৯৬ সালে যে ঘামিয়েছিল তার কারণ পরিস্থিতির বাস্তবতা, আওয়ামী লীগের তৎকালীন জনপ্রিয়তা এবং আন্দোলন করার সক্ষমতা ও কৌশল জানা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি কেন কেবল আমাদের এলিট শ্রেণীর অবসরের বিলাসী বিতর্ক তার একটা উদাহরণ দিই। সাবেক ব্যুরোক্র্যাট এবং ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সদস্য আকবর আলি খান একজন ভালো মানুষ এবং বুদ্ধিজীবীও। তিনি এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমর্থনে গলা মিলিয়েছেন, কিন্তু নিজে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রভাবশালী সদস্য থাকাকালে কয়েকজন সহকর্মীসহ যে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন, তার কারণগুলো খোলাসা করে বলেন না কেন?
লেখাটা শুরু করেছিলাম বিএনপির সরকার হটাও আন্দোলন বা আস্ফালন নিয়ে। এ সম্পর্কে একটি মজার কথা বলে লেখাটা শেষ করতে চাই। বিএনপির নিরপেক্ষ নামে পরিচিত সমর্থক দৈনিকটি আজকাল হরতাল করার বদলে কিভাবে সফল আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে, সে সম্পর্কে গাইডলাইন দেওয়া শুরু করেছে। একটি উপসম্পাদকীয়তে জোরালো ভাষায় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, হরতাল করে জনগণের মনে বিরক্তি উৎপাদন না করে বিএনপির নেতা-কর্মীরা কেন দলে দলে কারাবরণ করে দেশের সব জেল ভর্তি করে সরকারকে অচল করে দেয় না?
লেখাটি পড়ে খুব মজা পেয়েছি। মহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহ ও অহিংস আন্দোলনের ডাকে হাজার হাজার মানুষ স্বেচ্ছায় কারাবরণ করে ব্রিটিশ-রাজের জেল ব্যবস্থা অচল করে দিত। আমার প্রশ্ন, বাংলাদেশের বর্তমান বিএনপি কি গায়ে-গতরে ব্রিটিশ আমলের কংগ্রেস? খালেদা জিয়ার ডাকে কয়জন নেতা-কর্মী যাবেন জেলখানা ভর্তি করতে? বেগম সাহেবা, একবার ডাক দিয়ে দেখুন। দলের কেন্দ্রীয় অফিস থেকে সব অফিস খালি হয়ে যাবে। ব্যারিস্টার মওদুদ যে এখন মিহিমিহি সুরে তর্জন-গর্জন করছেন, তাঁকেও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
লন্ডন, ১১ জুন, সোমবার, ২০১২

রবিবার, ১০ জুন, ২০১২

নোবেলজয়ীর কাছে আমার কিছু সবিনয় নিবেদন


আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
[সম্প্রতি ঢাকার কাগজগুলোতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ ও আমার শংকা’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ বেরিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় ১৫ মে, ২০১২ তারিখে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে তদন্ত করে কোন অনিয়ম হয়ে থাকলে তা দূর করার জন্য সরকারকে সুপারিশ জানাতে যে তদন্ত কমিশন গঠনের ব্যব¯’া করেছে, তাতে ড. ইউনূস তার নিবন্ধটিতে শংকা প্রকাশ করেছেন। আমি তার এই শংকা সম্পর্কে ঢাকার কাগজেই তাকে একটি খোলা চিঠি লিখেছি। ওই চিঠিটা প্রকাশের পর আমার মনে হয়েছে, তার কাছে আমার সব কথা নিবেদন করা হয়নি। তাই এই দ্বিতীয় খোলা চিঠি। (লেখক)]
শ্রদ্ধেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূস
আপনি একজন নোবেল-লরিয়েট। নোবেল পুরস্কার এখন যতই বিতর্কিত হোক, আপনার এই নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিতে বাংলাদেশের আর ১০ জন মানুষের মতো আমারও গর্বিত হওয়ার কথা। কিš‘ আমি গর্বিত হতে পারিনি দুই কারণে। প্রথমত, পুরস্কারটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনি যেভাবে নিজেই ‘অহংকারের এভারেস্টে’ আরোহণ করে এই পুরস্কার ও তার খ্যাতিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে (তখনকার আধাসামরিক শাসনের লক্ষ্য পূরণের যা সহায়ক হতে পারত) ব্যবহার করতে চাইলেন, এমনকি একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিলেন, তখন মনে হয়েছিল, আপনাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। 
দ্বিতীয়ত, গত মহাযুদ্ধের পর থেকেই নোবেল পুরস্কার তার আগের মর্যাদা হারিয়ে একটি বিতর্কিত পুরস্কার। বার্ট্রান্ড রাসেল পঞ্চাশের দশকেই বলেছেন, ‘নোবেল পুরস্কার এখন øায়ুযুদ্ধে পশ্চিমা শিবিরের হাতে একটি মোক্ষম হাতিয়ার। এই পুরস্কারের প্রবর্তক আলফ্রেড নোবেল আজ যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে হয় এই পুরস্কারদান-ব্যব¯’া বাতিল করতেন অথবা এই পুরস্কার থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করতেন।’
রাসেল অত্যুক্তি করেননি। শান্তির জন্য মহাÍা গান্ধী সর্বাগ্রে এই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হননি। বিবেচিত হয়েছেন ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী এক প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশে হয়েছেন আপনি।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘায়েল করার জন্য আমেরিকা øায়ুযুদ্ধে এই নোবেল পুরস্কার এত ন্যক্কারজনকভাবে ব্যবহার করেছে যে, এই পুরস্কারের আগেকার আন্তর্জাতিক ঔজ্জ্বল্য ও মর্যাদা এখন নিষ্প্রভ। সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘায়েল করার পর এখন এই হাতিয়ার ব্যবহার করা হ”েছ নয়াচীনের বির“দ্ধে। নয়াচীনের কমিউনিস্ট শাসন ও সংকুচিত নাগরিক স্বাধীনতার সমাজ ব্যব¯’ার বির“দ্ধে আমেরিকার দ্বারা প্ররোচিত ও উৎসাহিত হয়ে যারাই লেখালেখি করেন, তাদের বেছে নিয়ে নানা পুরস্কার দেয়া হয়। দেয়া হয়েছে নোবেল পুরস্কারও। 
গত বছর চীনের এমন এক সাহিত্যিককে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে এবং তাকে নিয়ে সারাবিশ্বে হইচই ফেলে দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি একজন পশ্চিমা সাহিত্য বিশেষজ্ঞ ও সমালোচক স্বীকার করেছেন, চীনের যে লেখককে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে, তার সাহিত্য উ”চমানের, কিš‘ আন্তর্জাতিকমানের নয়। তাকে মেধা ও মানের জন্য পুরস্কার দেয়া হয়নি, দেয়া হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। এই উদ্দেশ্য কমিউনিস্ট চীনকে বিব্রত করা।
এই একই উদ্দেশ্যে এক সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহিত্যিক বরিস প্যাস্তারনাককে তার ‘ড. জিভাগো’ বইয়ের জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছিল। এই বইটিকে টলস্টয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিসের’ সঙ্গে তুলনা করে বিশ্বব্যাপী দামামা পেটানো হয়েছিল। অথচ টলস্টয় নোবেল পুরস্কার পাননি। যেমন মহাÍা গান্ধী পাননি নোবেল শান্তি পুরস্কার। নোবেল পুরস্কারের আন্তর্জাতিক মর্যাদা বিতর্কিত হওয়ার আগেই বার্নার্ড শ’ এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পরবর্তীকালে মরমী দার্শনিক ও সাহিত্যিক জাঁ পল সার্ত্র এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘এই পুরস্কার নিলে আমি আমার শিল্পীর স্বাধীনতা হারাব এবং আমার মানবতাবাদী চেতনা আহত হবে।’ নোবেল পুরস্কারের বর্তমান স্ট্যাটাস সার্ত্রের এই উক্তি থেকে প্রণিধানযোগ্য। চকচক করলেই তামা যে সোনা হয় না তার প্রমাণ, এই সেদিনের নোবেল বিজয়ী বরিস প্যাস্তারনাক, তার বই ড. জিডাগোর নাম আজ আর কোথাও শোনা যায় না। বিস্মৃতির অন্ধকারে তা ডুবে গেছে। কিš‘ নোবেল প্রাইজ না পেয়েও টলস্টয় ও তার বই ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ দীর্ঘকাল ধরে সারাবিশ্বে আদৃত। টলস্টয় বা øায়ুযুদ্ধের আগে নোবেল প্রাইজ পাওয়া রবীন্দ্রনাথকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কোন প্রচার প্রোপাগান্ডার দরকার হয়নি। তারা নিজের গুণে এবং মাহাÍ্যইে মহীয়ান।
আপনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর বাংলাদেশে যে হইচই সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং আপনি নিজেও ‘আনন্দের এভারেস্টে’ আরোহণ করে হইচই শুর“ করেছিলেন, তা একমাত্র ‘হুজুগে বাঙালির’ দেশেই সম্ভব। আপনার আগে ড. অমর্ত্য সেন নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের লোক। তার এই পুরস্কার পাওয়া নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আদৌ হুজুগ সৃষ্টি করা হয়নি এবং তিনি নিজেও পুরস্কারটি নিজেকে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিকভাবে প্রোমোট করার কাজে লাগাননি। তিনি অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আপনি পুরস্কারটি নিজেকে রাজনৈতিকভাবে প্রোমোট করার কাজে লাগিয়েছেন।
ড. অমর্ত্য সেনের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা নিয়ে তার দেশেও কোন প্রশ্ন ওঠেনি। কিš‘ তার অর্থনৈতিক থিওরি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তার অর্থনীতিবিদ বন্ধুদেরই কেউ কেউ বলেছেন, ড. সেন তার অর্থনৈতিক থিওরিতে এক সময়ের অনুন্নত দেশগুলোতে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির যে প্রধান কারণগুলো দর্শিয়েছেন, তাতে আমেরিকাসহ পশ্চিমা সাবেক ঔপনিবেশিক দেশগুলো খুশি হয়েছে। কারণ, এ দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর শোষণ ও লুণ্ঠনের সরাসরি দায়কে এ থিওরিতে অনেকটাই আড়াল করে ফেলা হয়েছে। অমর্ত্য সেন তাই পুরস্কৃত হয়েছেন।
তবু অমর্ত্য সেন একটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ অর্থনৈতিক থিওরির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কিš‘ শ্রদ্ধেয় ড. ইউনূস, আপনাকে কোন্ থিওরি বা পাণ্ডিত্যের জন্য পুরস্কারটি দেয়া হল? আপনাকেও খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ বলা হয়। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়ার সময় মাস্টার্স ডিগ্রির পরীক্ষাতেও ফার্স্ট হতে পারেননি। হয়েছিলেন আপনার সহপাঠী ও বন্ধু ড. ফখর“দ্দীন আহমদ। তিনি একজন অত্যন্ত ভালো মানুষ। কিš‘ আপনার প্ররোচনায় এক-এগারোর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে গিয়ে তাকে আজ দেশছাড়া হতে হয়েছে। কথা ছিল, সেনা সমর্থিত সরকারের প্রধান আপনিই হবেন। আপনি আরও বড় উ”চাকাক্সক্ষা থেকে গোবেচারা ড. ফখর“দ্দীনকে স্টকিং হর্স হিসেবে ব্যবহার করে চমৎকারভাবে নিজেকে বাঁচিয়েছেন। না হলে আপনাকে নোবেল প্রাইজ দেয়ার আসল উদ্দেশ্য তখনই জানাজানি হয়ে যেত।
শ্রদ্ধাভাজন ড. ইউনূস, আমার এই খোলাচিঠিতে আপনার প্রতি কোন প্রকার রূঢ়তা প্রকাশ পেয়ে থাকলে আমাকে ক্ষমা করবেন। বর্তমানে আপনার ও আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে যা চলছে তা দেশের জন্য ভয়ানক বিপদ ডেকে আনতে পারে। এ বিপদ এড়ানোর জন্যই অকপটে কিছু কথা বলা দরকার মনে করছি। আমার বক্তব্য ও বিশ্লেষণে যদি কোন ভুল-ভ্রান্তি থাকে, তাহলে অবশ্যই তা খণ্ডন করবেন। আপনি একজন বিশ্ববরেণ্য মানুষ। আমার মতো এক নগণ্য সাংবাদিকের কথার জবাব দিতে আপনাকে স্বয়ং নামতে হবে না। আপনার চারপাশে আমার চেয়ে শক্তিশালী অনেক লেখক, সাংবাদিক, মুগ্ধ ভক্তের দল আছেন। আছে দুটি জবরদস্ত মিডিয়া। আপনি চাইলেই তারা আপনার হয়ে আমার বির“দ্ধে লাঠির বদলে তলোয়ার ঘোরাতে শুর“ করবে। আমি অবিনয়ী কথা বলে থাকতে পারি, কিš‘ অসত্য বলে থাকলে খণ্ডিত হোক তা চাই।
আপনাকে অর্থনীতিবিদ বলা হয়। সামাজিক ব্যবসা, গ্রামীণ ব্যাংক ইত্যাদি যে কোন বিষয়ে আপনার ‘উদ্ভাবনা বুদ্ধিকে’ ‘জগজ্জয়ী প্রতিভা’ আখ্যা দিয়ে আপনাকে নোবেল পুরস্কার দেয়া যেত। পশ্চিমারা বিশেষ করে আমেরিকা দিতে চাইলে তা ঠেকায় কে? সুতরাং এসব বিষয়ে আপনাকে নোবেল পুরস্কার না দিয়ে নোবেল শান্তির পুরস্কার কেন দেয়া হল এটা ডে ওয়ান থেকে আমার মনে প্রশ্ন। মহাÍা গান্ধী শান্তি ¯’াপনের লক্ষ্যে ইউরোপের বোয়ার যুদ্ধে ভলান্টিয়ার হয়েছিলেন। আপনাকে কোন যুদ্ধে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ভলান্টিয়ার হওয়া দূরের কথা নিজের ঘরের কাছে পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদনে বা সেই যুদ্ধে রক্তপাত বন্ধ করতে সামান্য ভূমিকাও গ্রহণ করতে দেখা যায়নি।
তাহলে কি গরিবকে চড়া সুদে ঋণ দেয়াটা শান্তি প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় অবদান? এ প্রশ্নের জবাব যদি হ্যাঁ সূচক হয়, তাহলে অবিভক্ত বাংলার একেবারে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ধনী-গরিব সব মানুষকে বিনা গ্যারান্টিতে চড়া সুদে ঋণ দেয়ার জন্য কাবুলিরা যে বিরাট নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল, সেই কাবুলিওয়ালাদের শান্তি পুরস্কার দেয়া উচিত ছিল। সে সময় অত্যাচারী জমিদারদের খাজনা পরিশোধের জন্য গরিব চাষীরা কাবুলিওয়ালাদের কাছ থেকেও চড়া সুদে টাকা কর্জ নিত। তার পর সেই সুদ দিতে না পারলে কাবুলিদের হাতে তাদের ভয়াবহ নির্যাতনের অন্ত থাকত না। গ্রামীণ ব্যাংকের সুদ আদায়ে এ কাবুলি পদ্ধতিকে মডেল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বলে শুনেছি। অনেক ঋণগ্রহীতা নাকি আÍহত্যাও করেছেন।
কেউ কেউ বলেছেন, সাহিত্যে, শিল্পে, বিজ্ঞানে, চিকিৎসাশাস্ত্রে বিরাট অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে আপনার কোন অবদান খুঁজে না পেয়েই আপনাকে নাকি শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়েছে। আপনাকে তখন আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোর বিশেষ স্বার্থে নোবেল পুরস্কার দিতেই হবে, সুতরাং শান্তির মতো নিরাকার বিষয়টি বেছে নেয়া হয়েছে। আপনাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া ঠিক হয়েছে কিনা, আওয়ামী লীগের এক বেকুব মন্ত্রীর মতো সেই প্রশ্ন আমি তুলছি না, বরং নোবেল পুরস্কার দেয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে এই বেকুব মন্ত্রী যে অর্বাচীন কথা বলেছেন, তাতে আমি লজ্জাবোধ করেছি। আপনার নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা সম্পর্কে আমার কোন প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন তুলছি এই পুরস্কারটি আপনাকে দেয়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে। এটা কি একটা কাকতালীয় ব্যাপার নয় যে, আপনি নোবেল পুরস্কার পেলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে সেটিকে মূলধন করে বাংলাদেশে হঠাৎ রাজনীতিকের ভূমিকায় নেমে এলেন? এবং তার আগে দেশে সেনা তাঁবেদার অগণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার কাজে সমর্থন ও সহায়তা জোগালেন? কোথায় আপনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার গৌরব ও মর্যাদাকে কাজে লাগিয়ে দেশে গণতন্ত্র রক্ষায় মহৎ ভূমিকা নেবেন, না আপনি গেলেন এক-এগারোর তথাকথিত সিভিল সরকারকে ক্ষমতা গ্রহণে সহায়তা দিতে এবং আপনার মনোনীত ব্যক্তিকেই সেই সরকার প্রধানের পদে বসাতে। আপনার নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় আমার গর্বিত বোধ না করার দ্বিতীয় কারণ এটি।
বাংলাদেশের তখন বড় দুর্দিন। দেশটির রাজনীতিকে শুদ্ধকরণের নামে (যে শুদ্ধিকরণের আপনি একজন বড় সমর্থক) সেনাবাহিনী সামনে শিখণ্ডী সিভিল সরকার খাড়া করে ক্ষমতা দখল করেছে। দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের নেত্রী জেলে। কারাবন্দি অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী। অত্যাচারের স্টিমরোলার নেমে এসেছে দেশের রাজনীতির ওপর। উদ্ভাবিত হয়েছে মাইনাস টু থিওরি। এই থিওরি বাস্তবায়নে সরবে সমর্থন জানা”েছ আপনার পৃষ্ঠপোষিত দুটি পত্রিকাই। 
শোনা গেল, এই মাইনাস টু থিওরির আসল উদ্ভাবক এবং সমর্থক পশ্চিমা দাতা দেশগুলো এবং তাদের অনুগৃহীত একটি বর্ণচোরা দেশী সুশীল সমাজ। আগে পশ্চিমা দেশগুলোÑ বিশেষ করে আমেরিকা অনুন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে গণতন্ত্র অকার্যকর এই ধুয়া তুলে সামরিক বাহিনী থেকে একজন ত্রাণকর্তা (ংধারড়ঁৎ) আবিষ্কার করে তাকে ক্ষমতায় বসাতেন। এখন কৌশল পাল্টে একজন ‘সিভিল ত্রাণকর্তা’ আবিষ্কার করে তাকে ক্ষমতায় বসান। যেমন, আফগানিস্তানে কারজাই এবং ইরাকে তারিকি। বাংলাদেশেও তখন আপনাকেই নাকি দেশটির সিভিল ত্রাণকর্তা হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিল। এবং সে জন্যই নাকি আপনাকে বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ও মর্যাদাবান করে তোলার উদ্দেশ্যে হয়েছিল তড়িঘড়ি এ নোবেল শান্তি পুরস্কার দানের ব্যব¯’া। 
এই শোনা কথা কতটা সঠিক তা আমি জানি না। কিš‘ নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আপনি দেশবাসীকে ‘আনন্দের এভারেস্ট চূড়ায়’ আরোহণের আহবান জানিয়ে যে কাজটি করলেন, তাতে এই শোনা কথায় বিশ্বাস ¯’াপন করতে ই”েছ হয়। আপনি পুরস্কারটি বগলদাবা করে দেশে ফিরে এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়েই নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিলেন। তখন বাংলাদেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ, রাজনৈতিক তৎপরতা আরও বেশি নিষিদ্ধ। ঠিক এই সময় আপনি কেমন করে দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দেন, প্রকাশ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা শুর“ করেন, সর্বোপরি এই তৎপরতা চালাতে এক-এগারোর সেনা তাঁবেদার সরকার আপনাকে সুযোগ ও সহায়তা দেন তা এক বিস্ময়কর ব্যাপার।
দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের নেত্রীই তখন কারাবন্দি। অসংখ্য রাজনৈতিক নেতাকর্মী জেলে। সারাদেশে ভীতির রাজত্ব। এমন সময় নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির খ্যাতি এবং আন্তর্জাতিক প্রভাবকে দুই নেত্রীর মুক্তি এবং দ্র“ত ভীতির রাজত্ব অবসানের কাজে না লাগিয়ে সেই প্রভাবকে কাজে লাগালেন নিজেকে রাজনৈতিক নেতা সাজানোর চেষ্টায় এবং দেশী-বিদেশী চক্রান্ত-জাত মাইনাস টু থিওরি বাস্তবায়নে সহায়তাদানের কাজে। নোবেল পুরস্কারকে মূলধন করে এটা তো ছিল ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার চেষ্টা করার মতো। কিš‘ আপনি হয়তো অত্যন্ত ঠেকে বুঝেছেন, প্রকৃত জনসেবার ট্র্যাক রেকর্ড না থাকলে এবং জনজীবনের শিকড়ে সমর্থন না থাকলে কেবল পুরস্কার, পদক ও বিদেশী মুরব্বিদের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক নেতা হওয়া যায় না। আপনি বুদ্ধিমান মানুষ। এটা বুঝতে পেরেই রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়েই দ্র“ত লক্ষ্য থেকে প্র¯’ান করেছেন।
আপনার সমর্থকরা প্রচার চালা”েছন এবং লন্ডনের প্রভাবশালী দ্য ইকনোমিস্ট কাগজকে কব্জা করে কাগজটি দ্বারা প্রচার চালানো হ”েছ, শেখ হাসিনা আপনাকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন এবং আপনার নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় ঈর্ষান্বিত। ইকনোমিস্টের সম্প্রতি লেখাগুলোর নেপথ্যে বসে যারা আপনার হয়ে নাটাই ঘোরা”েছন, তারা কাগজটিকে দিয়ে এমন কথাও বলিয়েছেন যে, ‘হাসিনা সরকার গ্রামীণ ব্যাংকটিকে গ্রাস করতে চায়।’ আর কেউ না জানুক, আপনি জানেন, দুটি অভিযোগই সঠিক নয়। সরকারি অর্থ সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক সরকার গ্রাস করে কীভাবে? শেখ হাসিনা নিজে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার জন্য মনে মনে খুবই আশা পোষণ করতে পারেন, কিš‘ বাংলাদেশের একজন সম্মানিত নাগরিক নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় মোটেই ঈর্ষান্বিত হননি। বরং খুশিই হয়েছিলেন। বাঙালিদের নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় তিনি আনন্দিত ও গর্বিত না হলে আরেক বাঙালি নোবেলজয়ী ড. অমর্ত্য সেনকে বারবার ঢাকায় ডেকে এনে সম্মান দেখাতেন না। আপনাকেও তিনি সম্মান দেখাতেন এবং অমর্ত্য সেনের মতোই বারবার কাছে টেনে নিতেন, যদি নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আপনার চেহারাটি বেরিয়ে না আসত। এই চেহারাটি একজন ক্ষমতালোভী ব্যবসায়ীর, নোবেলজয়ী মনীষীর নয়।
আপনি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চাইলে তার ভীত হওয়ার কারণ ছিল না এবং এখনও নেই। আপনার আগে ড. কামাল হোসেনের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতির অধিকারী অনেক নেতার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয়েছেন তিনি এবং যুদ্ধে নামতে ভয় পাননি। এক্ষেত্রে আপনাকে ভয় পাবেন কেন? রাজনীতির মাঠে তিনি আরেকজন প্রতিদ্বন্দ্বীর সম্মুখীন হতেন মাত্র। কিš‘ আপনি নোবেল পুরস্কার ও বিদেশী মদদকে কাজে লাগিয়ে কেবল হাসিনা বা আওয়ামী লীগের বিরোধিতায় নামেননি, নামলে কথা ছিল না, আপনি নেমেছেন দেশের গণতন্ত্রবিরোধী চক্রগুলোকে মদদ জোগাতে। মাইনাস টু থিওরির বাস্তবায়ন এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে পশ্চিমা দাতা দেশগুলোর স্বার্থপূরণের কাজে। আপনার রাজনৈতিক দল গঠন ছিল একটি ভাঁওতা। আপনার লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে রাজনীতিবর্জিত অগণতান্ত্রিক ব্যব¯’ার দিকে ঠেলে নেয়া।
ফলে শুধু শেখ হাসিনা নন, দেশের বাম ও গণতান্ত্রিক দল এবং বুদ্ধিজীবীরাও (আপনার পেটোয়া বুদ্ধিজীবীরা ছাড়া) আপনার ভূমিকা সম্পর্কে সন্ধিগ্ধ ও সতর্ক হয়েছেন। আপনি নোবেল পুরস্কার এবং গ্রামীণ ব্যাংকটিকেও আপনার রাজনৈতিক উ”চাকাক্সক্ষা ও স্বার্থ পূরণের উদ্দেশ্যে কি কাজে লাগাতে চাননি? এখন যদি গ্রামীণ ব্যাংকের ৩৪ বছরের কার্যকলাপ সম্পর্কে একটি সুষ্ঠু তদন্ত হয়, তাহলে হয়তো অনেক গুর“তর অনিয়ম বের হয়ে আসবে। আপনি যে সেই ভয়ে ভীত, আপনার ৩১ মে তারিখে ঢাকার কাগজগুলোতে প্রকাশিত ‘গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ এবং আমার শংকা’ শীর্ষক প্রবন্ধটিতে তা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে।
আর এই ভয় থেকে আপনি হিলারি ক্লিনটনকে দিয়ে আবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি লিখিয়েই ক্ষান্ত হননি, আপনি ছুটে গেছেন ব্রিটেনের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আলস্টার বার্টের কাছে। তাকে দিয়ে আবার বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টিমূলক উক্তি করিয়েছেন। এটা একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশী হস্তক্ষেপ ডেকে আনা। এ সম্পর্কে বাংলাদেশেরই একজন কলামিস্ট ও গবেষক রতন তনু ঘোষ সম্প্রতি তার এক লেখায় মন্তব্য করেছেন, ‘একজন নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব রাজনীতি সম্পর্কে তার অভিমত দিতে পারেন। কিš‘ দেশের রাজনীতিকে বিদেশী হস্তক্ষেপের মুখোমুখি দাঁড় করাবেন, এটা কারও কাম্য নয়।’ এই মন্তব্য একজন দেশপ্রেমিক বাঙালির। আমার ধারণা গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে তদন্ত কমিশন গঠনেই আমাদের নোবেলজয়ী এত ভীত হয়ে পড়েছেন।
লন্ডন ।। ১০ জুন ।। রোববার ২০১২