ত রি কু ল ই স লা ম
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে আজ বড় বেশি মনে পড়ে। বাংলাদেশের এ ক্রান্তিকালে শহীদ জিয়াকে মনে পড়ার যথেষ্ট কারণও আছে। তিনি আমাদের অনুপ্রেরণার উত্স। জিয়াউর রহমান এক অবিস্মরণীয় নাম। আমাদের জাতিসত্তার মহান রূপকার। স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রনায়ক। মহান মুক্তিযুদ্ধের এক বীর সেনানী। মহান স্বাধীনতার ঘোষক। তিনি জাতীয়তাবাদী আদর্শের মূর্ত প্রতীক।
শহীদ জিয়াকে আমরা জাতির ক্রান্তিকালে স্বরূপে দেখেছি। ১৯৭১ সালে দেশমাতৃকার স্বাধীনতা সংগ্রামে দেখেছি সমর নায়ক হিসেবে। আবার দেখেছি ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে সিপাহী-জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে। ১৯৮১ সালে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত দেখেছি আরেক রূপে, বাংলাদেশকে আধুনিক রূপে গড়ে তোলার কারিগর হিসেবে। জিয়াউর রহমানকে ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে দেখা যায় স্বমহিমায়। তাঁর উন্নত চারিত্রিক দৃঢ়তা, সততা, গভীর দেশপ্রেম আমাদের চেতনাকে শাণিত করেছে। ব্যক্তি জিয়াউর রহমান আর রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের মধ্যে আমরা কোনো তফাত খুঁজে পাই না। বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর যখন চারদিকে এক তমসাচ্ছন্ন পরিবেশ, হতাশা আর গ্লানিময় শাসন বাকরুদ্ধ অবস্থা তৈরি করেছিল, জিয়াউর রহমান তখন এগিয়ে এসেছিলেন অন্ধকারের দিশা হিসেবে। স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব নিয়েই যখন প্রশ্ন উঠেছিল জিয়াউর রহমান তখন হতাশাগ্রস্ত জাতির মনে আশার সঞ্চার করেন। জিয়াউর রহমানের তুলনা তিনি নিজেই। একজন সহকর্মী হিসেবে আজ বহুদিন পর স্মৃতির মানসপটে তাঁর যে প্রতিচ্ছবি দেখি তাতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। তাঁর তুলনা খুঁজে পাই না। মানুষ হিসেবে প্রত্যেকেরই কিছু ত্রুটি থাকে, বিচ্যুতি থাকে। রাষ্ট্রনায়ক বা জাতীয় নেতারাও এই সমাজেরই অংশ। ফলে আমরা দেখি একজন আদর্শবাদী নেতাও জীবনের শেষদিন পর্যন্ত নীতি-আদর্শের উপরে অবিচল থাকতে পারেন না। এই বিচ্যুতি জীবনের সব অর্জনকে ম্লান করে দেয়। কিন্তু, জিয়াউর রহমানের জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমরা তেমন কিছু দেখি না। সততা একজন মানুষকে মহত্ করে। সততাবিহীন জীবন নীতির প্রশ্নে আপস করে। জিয়াউর রহমান সততার ক্ষেত্রে কোনোদিন আপস করেননি। বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের অনেক গভীরে তাঁর স্থান। তার সাদামাটা জীবন, নির্লোভ মানসিকতা, গভীর দেশপ্রেম বিরল। জিয়াউর রহমান পেশায় সৈনিক ছিলেন। একজন সেনানায়কের চারিত্রিক দৃঢ়তা দিয়ে তিনি তাঁর চারপাশের পরিবেশ মুগ্ধ করেছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের এক চরম ক্রান্তিলগ্নে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। একটা জাতির জীবনে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এদেশের মানুষ এ দুয়ের জন্য যুগে যুগে লড়াই করেছে, সংগ্রাম করেছে নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য। জিয়াউর রহমান এই দুই বিরল অর্জনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। একজন সহকর্মী হিসেবে দেখেছি, কি অমিত তেজ আর সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচনে তাকে পরিশ্রম করতে। চারণের মতো বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন।
জিয়াউর রহমান নতুন রাজনীতি শিখিয়েছেন। সে রাজনীতি ছিল উন্নয়নের রাজনীতি। আমাদের জাতীয় চেতনা ও আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে নতুন দেশ গড়ার রাজনীতি তিনি আমাদের শিখিয়েছেন। তিনি সমন্বয়ের নতুন যে রাজনৈতিক দর্শন উপস্থাপন করে গেছেন, তার কোনো তুলনা হয় না। আমরা সহকর্মীরা কাজ করার সময় দেখেছি, তিনি সবার কথা শুনছেন, সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন, আবার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় সবাইকে সম্পৃক্ত করছেন। রাজনীতির গতানুগতিকতার বাইরে উঠে তিনি সারা বাংলাদেশকে এক করেছিলেন। প্রতিদিন টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, রূপসা থেকে পাটুরিয়া পর্যন্ত তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। আবার ঢাকায় ফিরে এসে প্রশাসনের কাজকর্ম তদারক করেছেন। মাত্র পাঁচ বছরেই দেশের চেহারাটা পাল্টে ফেলেছিলেন তিনি। জাতির ঘনঘোর দুর্দিনে তিনি এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁর এ আগমনে সবার মধ্যেই প্রাণের স্পন্দন ফিরে এসেছিল। জীবনে যখন তিনি যে কাজে হাত দিয়েছেন, পরিকল্পনা করেছেন, তা বাস্তবায়ন করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি নতুন বিপ্লবের সূচনা করেন। তখন আট কোটি মানুষের ষোল কোটি হাতকে তিনি কর্মীর হাতে রূপান্তর করেন। তিনি লক্ষ্য করেন, যে গতানুগতিক রাজনীতি বাংলাদেশে বিদ্যমান তা দিয়ে জাতির আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না। এ রাজনীতি পশ্চাত্পদ। অনেকটা প্রাচীন। বিশ্ব এগিয়ে গেছে। সদ্য স্বাধীন দেশ হিসেবে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। এই পশ্চাত্পদতা কাটিয়ে উঠতে হলে সবাইকে নিয়েই এবং বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে এগুতে হবে। তিনি চিহ্নিত করলেন আমাদের সমস্যাগুলো কী? দেখলেন নেতৃত্ব পেলে এ জাতি পৃথিবীতে অনেক কিছুই করতে পারে। ১৯৭১ সালে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করে অতি অল্প সময়েই স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। তাদের এই শৌর্য সমগ্র বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু এরপর যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলো সে জন্য জনগণ দায়ী নয়। বরং এটি ছিল নেতৃত্বের ব্যর্থতা। জিয়াউর রহমান এ অবস্থায় নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু জাতির আকাঙ্ক্ষা ছিল অন্য রকম। এই আকাঙ্ক্ষা পূরণেই এগিয়ে আসতে হলো তাকে। সিপাহী-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন তরুণ জিয়াউর রহমান। স্বস্তি পেল জাতি। এ দেশের মানুষকে তিনি হারানো গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিলেন। এজন্য জিয়াউর রহমান হয়ে উঠলেন সব আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দু।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবার সহাবস্থান নিশ্চিত করলেন জিয়াউর রহমান। তিনি যে কতটা দূরদর্শী ছিলেন তা তাঁর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের সমাজ চরমভাবাপন্ন নয়। এখানকার মানুষের আকাঙ্ক্ষাও খুব বেশি নয়। এ জাতিকে তিনি উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখালেন। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে নতুন করে পরিচিত করলেন। যুবসমাজকে টেনে আনলেন উন্নয়নের মূল স্রোতে। আমরা অনেকেই সে সময় ছিলাম ভিন্ন ধারার রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে যুক্ত। জিয়াউর রহমান সবাইকে কাছে টেনে আনলেন। তিনি কোনো পার্থক্য করলেন না। মুসলিম দুনিয়ার সঙ্গেও তৈরি করলেন নতুন সেতুবন্ধন। প্রযুক্তিনির্ভর দেশগুলো থেকে তিনি প্রযুক্তি আমদানি করলেন। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশকে তিনি সবুজ বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেলেন। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং সম্মানের সঙ্গে বসবাসকে অগ্রাধিকার দিলেন তিনি। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করে বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে চাইলেন অনেক উচ্চে। এগিয়ে নিয়েও গেলেন তিনি। সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা জিয়া। দক্ষিণ এশীয় সংস্থার মাধ্যমে এই অঞ্চলকে এক ভিন্ন পরিচয়ে পরিচিত করে তোলার চেষ্টা চালিয়েছেন তিনি। তিনি ছিলেন এর রূপকার। আফসোস হয় যখন দেখি, আজ একটি বিশেষ গোষ্ঠী শহীদ জিয়াউর রহমানকে নিয়ে কটুক্তি করার চেষ্টা করে। তাঁর অতীত কর্মকাণ্ডে কালিমা লেপন করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে নতুন করে। কিন্তু শহীদ জিয়ার কর্মযজ্ঞের সময়কালে তারা কোথায় ছিলেন? সে দিন তারা তার সমালোচনা করার মতো কোনো কিছুই পাননি। অথচ আজ এতদিন পর এসে বৃথা বিতর্কের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। জিয়াউর রহমান সামরিক শাসন জারি করেননি। তাকে সামরিক শাসক বলা যায় না। তাঁর রাজনীতিতে আগমন ঘটেছিল এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে। কিন্তু এ দেশের সামরিক বাহিনীকে পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। তিনি একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। তবে সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার হতে দেননি তিনি। এ তাঁর দূরদর্শিতার আরেক পরিচয়। জিয়াউর রহমান চেয়েছেন রাজনীতিবিদরা দেশের মানুষের দোরগোড়ায় যাক। উন্নয়ন শুধু এক স্থানেই নয়, সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ুক। এ পরিকল্পনায় সফল হয়েছিলেন তিনি। আর এসব কারণেই জিয়াউর রহমান তাঁর মৃত্যুর এত বছর পরও সমান জনপ্রিয়। আর তাঁর প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপিও এ দেশের জনগণের কাছে বিপুলভাবে সমাদৃত। এর কারণ একটিই। তা হলো এ দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রতিফলন ছিল জিয়ার রাজনৈতিক দর্শনে। এ কারণেই তাঁর শাহাদাতের পর পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছিল—‘একটি লাশের পাশে সমগ্র বাংলাদেশ’।
লেখক : স্থায়ী কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও সাবেক মন্ত্রী
শহীদ জিয়াকে আমরা জাতির ক্রান্তিকালে স্বরূপে দেখেছি। ১৯৭১ সালে দেশমাতৃকার স্বাধীনতা সংগ্রামে দেখেছি সমর নায়ক হিসেবে। আবার দেখেছি ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে সিপাহী-জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে। ১৯৮১ সালে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত দেখেছি আরেক রূপে, বাংলাদেশকে আধুনিক রূপে গড়ে তোলার কারিগর হিসেবে। জিয়াউর রহমানকে ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে দেখা যায় স্বমহিমায়। তাঁর উন্নত চারিত্রিক দৃঢ়তা, সততা, গভীর দেশপ্রেম আমাদের চেতনাকে শাণিত করেছে। ব্যক্তি জিয়াউর রহমান আর রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের মধ্যে আমরা কোনো তফাত খুঁজে পাই না। বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর যখন চারদিকে এক তমসাচ্ছন্ন পরিবেশ, হতাশা আর গ্লানিময় শাসন বাকরুদ্ধ অবস্থা তৈরি করেছিল, জিয়াউর রহমান তখন এগিয়ে এসেছিলেন অন্ধকারের দিশা হিসেবে। স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব নিয়েই যখন প্রশ্ন উঠেছিল জিয়াউর রহমান তখন হতাশাগ্রস্ত জাতির মনে আশার সঞ্চার করেন। জিয়াউর রহমানের তুলনা তিনি নিজেই। একজন সহকর্মী হিসেবে আজ বহুদিন পর স্মৃতির মানসপটে তাঁর যে প্রতিচ্ছবি দেখি তাতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। তাঁর তুলনা খুঁজে পাই না। মানুষ হিসেবে প্রত্যেকেরই কিছু ত্রুটি থাকে, বিচ্যুতি থাকে। রাষ্ট্রনায়ক বা জাতীয় নেতারাও এই সমাজেরই অংশ। ফলে আমরা দেখি একজন আদর্শবাদী নেতাও জীবনের শেষদিন পর্যন্ত নীতি-আদর্শের উপরে অবিচল থাকতে পারেন না। এই বিচ্যুতি জীবনের সব অর্জনকে ম্লান করে দেয়। কিন্তু, জিয়াউর রহমানের জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমরা তেমন কিছু দেখি না। সততা একজন মানুষকে মহত্ করে। সততাবিহীন জীবন নীতির প্রশ্নে আপস করে। জিয়াউর রহমান সততার ক্ষেত্রে কোনোদিন আপস করেননি। বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের অনেক গভীরে তাঁর স্থান। তার সাদামাটা জীবন, নির্লোভ মানসিকতা, গভীর দেশপ্রেম বিরল। জিয়াউর রহমান পেশায় সৈনিক ছিলেন। একজন সেনানায়কের চারিত্রিক দৃঢ়তা দিয়ে তিনি তাঁর চারপাশের পরিবেশ মুগ্ধ করেছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের এক চরম ক্রান্তিলগ্নে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। একটা জাতির জীবনে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এদেশের মানুষ এ দুয়ের জন্য যুগে যুগে লড়াই করেছে, সংগ্রাম করেছে নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য। জিয়াউর রহমান এই দুই বিরল অর্জনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। একজন সহকর্মী হিসেবে দেখেছি, কি অমিত তেজ আর সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচনে তাকে পরিশ্রম করতে। চারণের মতো বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন।
জিয়াউর রহমান নতুন রাজনীতি শিখিয়েছেন। সে রাজনীতি ছিল উন্নয়নের রাজনীতি। আমাদের জাতীয় চেতনা ও আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে নতুন দেশ গড়ার রাজনীতি তিনি আমাদের শিখিয়েছেন। তিনি সমন্বয়ের নতুন যে রাজনৈতিক দর্শন উপস্থাপন করে গেছেন, তার কোনো তুলনা হয় না। আমরা সহকর্মীরা কাজ করার সময় দেখেছি, তিনি সবার কথা শুনছেন, সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন, আবার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় সবাইকে সম্পৃক্ত করছেন। রাজনীতির গতানুগতিকতার বাইরে উঠে তিনি সারা বাংলাদেশকে এক করেছিলেন। প্রতিদিন টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, রূপসা থেকে পাটুরিয়া পর্যন্ত তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। আবার ঢাকায় ফিরে এসে প্রশাসনের কাজকর্ম তদারক করেছেন। মাত্র পাঁচ বছরেই দেশের চেহারাটা পাল্টে ফেলেছিলেন তিনি। জাতির ঘনঘোর দুর্দিনে তিনি এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁর এ আগমনে সবার মধ্যেই প্রাণের স্পন্দন ফিরে এসেছিল। জীবনে যখন তিনি যে কাজে হাত দিয়েছেন, পরিকল্পনা করেছেন, তা বাস্তবায়ন করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি নতুন বিপ্লবের সূচনা করেন। তখন আট কোটি মানুষের ষোল কোটি হাতকে তিনি কর্মীর হাতে রূপান্তর করেন। তিনি লক্ষ্য করেন, যে গতানুগতিক রাজনীতি বাংলাদেশে বিদ্যমান তা দিয়ে জাতির আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না। এ রাজনীতি পশ্চাত্পদ। অনেকটা প্রাচীন। বিশ্ব এগিয়ে গেছে। সদ্য স্বাধীন দেশ হিসেবে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। এই পশ্চাত্পদতা কাটিয়ে উঠতে হলে সবাইকে নিয়েই এবং বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে এগুতে হবে। তিনি চিহ্নিত করলেন আমাদের সমস্যাগুলো কী? দেখলেন নেতৃত্ব পেলে এ জাতি পৃথিবীতে অনেক কিছুই করতে পারে। ১৯৭১ সালে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করে অতি অল্প সময়েই স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। তাদের এই শৌর্য সমগ্র বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু এরপর যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলো সে জন্য জনগণ দায়ী নয়। বরং এটি ছিল নেতৃত্বের ব্যর্থতা। জিয়াউর রহমান এ অবস্থায় নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু জাতির আকাঙ্ক্ষা ছিল অন্য রকম। এই আকাঙ্ক্ষা পূরণেই এগিয়ে আসতে হলো তাকে। সিপাহী-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন তরুণ জিয়াউর রহমান। স্বস্তি পেল জাতি। এ দেশের মানুষকে তিনি হারানো গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিলেন। এজন্য জিয়াউর রহমান হয়ে উঠলেন সব আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দু।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবার সহাবস্থান নিশ্চিত করলেন জিয়াউর রহমান। তিনি যে কতটা দূরদর্শী ছিলেন তা তাঁর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের সমাজ চরমভাবাপন্ন নয়। এখানকার মানুষের আকাঙ্ক্ষাও খুব বেশি নয়। এ জাতিকে তিনি উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখালেন। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে নতুন করে পরিচিত করলেন। যুবসমাজকে টেনে আনলেন উন্নয়নের মূল স্রোতে। আমরা অনেকেই সে সময় ছিলাম ভিন্ন ধারার রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে যুক্ত। জিয়াউর রহমান সবাইকে কাছে টেনে আনলেন। তিনি কোনো পার্থক্য করলেন না। মুসলিম দুনিয়ার সঙ্গেও তৈরি করলেন নতুন সেতুবন্ধন। প্রযুক্তিনির্ভর দেশগুলো থেকে তিনি প্রযুক্তি আমদানি করলেন। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশকে তিনি সবুজ বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেলেন। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং সম্মানের সঙ্গে বসবাসকে অগ্রাধিকার দিলেন তিনি। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করে বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে চাইলেন অনেক উচ্চে। এগিয়ে নিয়েও গেলেন তিনি। সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা জিয়া। দক্ষিণ এশীয় সংস্থার মাধ্যমে এই অঞ্চলকে এক ভিন্ন পরিচয়ে পরিচিত করে তোলার চেষ্টা চালিয়েছেন তিনি। তিনি ছিলেন এর রূপকার। আফসোস হয় যখন দেখি, আজ একটি বিশেষ গোষ্ঠী শহীদ জিয়াউর রহমানকে নিয়ে কটুক্তি করার চেষ্টা করে। তাঁর অতীত কর্মকাণ্ডে কালিমা লেপন করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে নতুন করে। কিন্তু শহীদ জিয়ার কর্মযজ্ঞের সময়কালে তারা কোথায় ছিলেন? সে দিন তারা তার সমালোচনা করার মতো কোনো কিছুই পাননি। অথচ আজ এতদিন পর এসে বৃথা বিতর্কের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। জিয়াউর রহমান সামরিক শাসন জারি করেননি। তাকে সামরিক শাসক বলা যায় না। তাঁর রাজনীতিতে আগমন ঘটেছিল এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে। কিন্তু এ দেশের সামরিক বাহিনীকে পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। তিনি একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। তবে সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার হতে দেননি তিনি। এ তাঁর দূরদর্শিতার আরেক পরিচয়। জিয়াউর রহমান চেয়েছেন রাজনীতিবিদরা দেশের মানুষের দোরগোড়ায় যাক। উন্নয়ন শুধু এক স্থানেই নয়, সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ুক। এ পরিকল্পনায় সফল হয়েছিলেন তিনি। আর এসব কারণেই জিয়াউর রহমান তাঁর মৃত্যুর এত বছর পরও সমান জনপ্রিয়। আর তাঁর প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপিও এ দেশের জনগণের কাছে বিপুলভাবে সমাদৃত। এর কারণ একটিই। তা হলো এ দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রতিফলন ছিল জিয়ার রাজনৈতিক দর্শনে। এ কারণেই তাঁর শাহাদাতের পর পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছিল—‘একটি লাশের পাশে সমগ্র বাংলাদেশ’।
লেখক : স্থায়ী কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও সাবেক মন্ত্রী