বৃহস্পতিবার, ১৭ মে, ২০১২

ভারতীয় গণতন্ত্রে ফাটল এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর বিপদাশঙ্কা



লেখক: আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী 
আমাকে এক সময় ভারত-প্রেমিক বলা হতো। যারা আমার লেখা বা আমাকে পছন্দ করেন না, তারা বলতেন, ‘ভারতের দালাল’। বিশেষ করে পাকিস্তানপন্থীরাই আমাকে এই গালিটা দিতেন। আমি তাতে কখনো দুঃখবোধ করিনি। কারণ, আমি তো একজন নগণ্য সাংবাদিক। পাকিস্তানের শাসক এবং তাদের অনুসারী ও অনুগৃহীত ব্যক্তিরা শেরে বাংলা ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানীর মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় জননেতাদের পর্যন্ত ‘ভারতের দালাল’, ‘হিন্দুদের দালাল’, ইত্যাদি বলে গালি দিত। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় যার অবদান সবচাইতে বেশি, সেই শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী করাচির জাহাঙ্গীর পার্কের জনসভায় দাঁড়িয়ে গালি দিয়েছিলেন, ‘ভারতের লেলিয়ে দেওয়া পাগলা কুত্তা’ (a mad dog let loose by India)।
পাকিস্তান আমলে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) যেসব বাঙালি নেতা গণতন্ত্র, বাঙালির স্বায়ত্তশাসন এবং ভাষা সংস্কৃতির অধিকারের পক্ষে কথা বলতেন, তাদেরই ঢালাওভাবে ভারতের দালাল আখ্যা দেওয়া হতো। ড. শহীদুল্লাহর মতো বিদ্বান মনীষীরা এই গালি থেকে অব্যাহতি পাননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তো ছয় দফা দাবির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করায় রাষ্ট্রদ্রোহী এবং ভারতের সঙ্গে যোগসাজশে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টার অভিযোগে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়’ আসামি করা হয়েছিল।
অর্থাত্ পাকিস্তান আমলে যারাই গণতন্ত্র, সেক্যুলার জাতীয়তা, জাতিগত ভাষা সংস্কৃতির অধিকার ও অর্থনৈতিক সমঅংশীদারিত্বের দাবি তুলেছেন, তাদেরই ‘ভারতের দালাল’, ‘হিন্দুদের দালাল’ ইত্যাদি বলে গালি দেওয়া হয়েছে এবং নানাভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। অতীতের এই ঘটনাগুলোর কথা এজন্যেই উল্লেখ করলাম যে, পাকিস্তানে যারা গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার ও সেক্যুলার জাতিসত্তার কথা বলতেন, তারা ভারতের দালাল ছিলেন না, তবে অনেকেই ভারতের প্রতি অনুরাগ পোষণ করতেন, দেশটির গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের জন্য। তাছাড়া নেহেরু সরকার থেকে ইন্দিরা সরকার পর্যন্ত ভারতের যে সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী দৃঢ় ভূমিকা ছিল, তা এশিয়ার সদ্য স্বাধীন দেশগুলোর জন্য ছিল অনুপ্রেরণার উত্স।
ব্রিটেনের ওয়েস্টমিন্স্টার ডেমোক্রেসি যেমন এক সময় সারাবিশ্বে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ভারতীয় গণতন্ত্রও তেমনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর সদ্য স্বাধীন দেশগুলোর জন্য একটি মডেল হয়ে দাঁড়াবে।
এটা ছিল অনেকেরই আশা। আমার মতো নগণ্য একজন সাংবাদিকও ভারতের প্রতি অনুরাগ পোষণ করতাম, তা এই ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য। ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দৃঢ় ভূমিকা নিয়ে আত্মদান করেছেন, নেহেরু আমেরিকার নব্য সাম্রাজ্যবাদী সামরিক চুক্তির ফাঁদে পা দেননি; (যে ফাঁদে পা দিয়ে পাকিস্তান আজ ন্যাটোর প্রাত্যহিক ড্রোন হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে), নেহেরু কন্যা ইন্দিরা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে অকুতোভয়ে সাহায্য দিয়েছেন, সোয়া কোটি বাংলাদেশি শরণার্থীকে ভারতে আশ্রয় দিয়ে দশ মাসের বেশি খাইয়েছেন, পরিয়েছেন এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে ১৮ হাজার ভারতীয় সৈন্য আত্মাহুতি দিয়েছে, এসব কারণে বাংলাদেশে অসংখ্য দেশপ্রেমিক মানুষের মতো ভারতের প্রতি অকৃত্রিম বন্ধুত্বের মনোভাব আমার মনেও গড়ে উঠতে দেরি হয়নি।
একই কারণে পাকিস্তানের প্রতি আমার ছিল বীতরাগ। একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র, যা এ যুগে অচল ও অবাস্তব, জন্ম থেকেই যে রাষ্ট্রে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা কার্যত সমান নাগরিক অধিকার বঞ্চিত এবং নিগৃহীত; যে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ‘কায়েদে আজম’ মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও কাজে ডিকটেটরসুলভ মনোভাব নিয়ে একটি ধর্মীয় ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র কাঠামো তৈরির সূচনা করে গেছেন, সেই দেশটি আজ অর্ধ তালিবান রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে মিত্র আমেরিকার অকুপাইড দেশ এবং মিত্রের বোমা হামলায় ধ্বংসের পথে।
উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর গণতন্ত্রবিহীন পাকিস্তানের পশ্চাত্গতি এবং গণতান্ত্রিক ভারতের অগ্রগতি শেষোক্ত দেশটির প্রতিই আমাদের অনুরাগ বৃদ্ধি করেছে। ভারত আমাদের বিরাট প্রতিবেশী দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে আমরা আশা করেছি, পাকিস্তানের শাসন ও শোষণ থেকে মুক্ত হওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশ নেহেরুর সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো অনুসরণে একটি সেক্যুলার ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠবে। আমাদের সে আশা অবশ্য পূর্ণ হয়নি।
এখন ভাবতেও শিউরে উঠি, আমরা যদি এখনো পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত পূর্ব পাকিস্তান থাকতাম, তাহলে বর্তমানে পাকিস্তানে যা ঘটছে, তার অংশভাগী আমাদেরও হতে হতো। ঢাকা এবং অন্যান্য শহরেও ন্যাটোর ড্রোন হামলা চলতে থাকলে বিস্ময়ের কিছু ছিলো না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের বাঁচিয়েছে। এখনো পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত থাকলে সেখানকার মৌলবাদী সন্ত্রাসের ঢেউ এখানেও পূর্ণভাবে ছড়াতো এবং তা দমনের নামে ন্যাটোর তত্পরতা পূর্ব পাকিস্তানেও ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করতো।
পাকিস্তানের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়েও আমরা সম্পূর্ণ বাঁচতে পারিনি। বাংলাদেশের আইএসআইয়ের তত্পরতা জামায়াত এবং আরো কয়েকটি সন্ত্রাসী মৌলবাদী দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এখানেও মৌলবাদী উত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেছে। আমাদের ভাগ্য ভালো বিশ্ব পরিস্থিতির আকস্মিক পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সেক্যুলার শক্তি নির্বাচনে জিতে (২০০৮) ক্ষমতায় বসতে পেরেছে এবং সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তিকে আপাতত রুখে দিতে পেরেছে। তাতেও সন্ত্রাসী মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক চক্র সম্পূর্ণ পরাজিত হয়নি। তাদের পেছনেও আন্তর্জাতিক মদদ আছে। সেই মদদের জোরে এখনও তারা কখনো ধর্ম, কখনো গণতন্ত্র ইত্যাদির ছদ্মবেশে সারা বাংলাদেশে অস্থিরতা ও অরাজকতা সৃষ্টিতে ব্যস্ত। এ সময় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার রাজনীতির একটি বড় ভরসা ছিলো পাশের বড় প্রতিবেশী গণতান্ত্রিক ভারত। শুধু বাংলাদেশ নয়, এশিয়া এবং আফ্রিকারও অনেক সদ্য স্বাধীন দেশ আশা করেছে তাদের নতুন এবং দুর্বল গণতন্ত্র যাতে বাইরের বা ভেতরের ষড়যন্ত্রে ভেঙে না পড়ে, সেজন্যে ভারতীয় গণতন্ত্র তাদের মাথার উপর ছাতার মতো (Protactive Umbrella) থাকবে। যতোদিন নেহেরু ও ইন্দিরা গান্ধী বেঁচে ছিলেন এবং ভারতে শাসন ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ ছিলো, ততোদিন ভারত তার এই ভূমিকা যে একেবারে পালন করেনি তা নয়। ভারত স্বাধীন হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ইন্দোনেশিয়ায় সুকর্ণের নেতৃত্বে ‘মারদেকা’ বা তাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়। এই স্বাধীনতার যুদ্ধ দমন করার জন্য ডাচ সাম্রাজ্যবাদীরা চেয়েছিল ভারতের আকাশ সীমা ব্যবহার করে ইন্দোনেশিয়ায় বিমান হামলা চালাতে। নেহেরু তখনো শক্ত হয়ে ক্ষমতায় বসেননি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ভারতের আকাশ সীমা দিয়ে ডাচদের সকল বিমান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করলে ভারত তার তীব্র প্রতিবাদ করেছে এবং এই সেদিন পর্যন্ত মিয়ানমারের সামরিক শাসন-বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সাহায্য জুগিয়েছে। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত গেরিলাদের ভারতে আশ্রয় দিয়েছে এবং তাদের ট্রেনিং দানও করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ইন্দিরা সরকারের সর্বাত্মক সাহায্য ও সমর্থন দানের কথাতো আর নতুন করে লেখার দরকার নেই। এখানেই ভারতের পাশাপাশি নয়াচীনের ভূমিকার কথাও আসে। ভারত স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৭ সালে। তার দেড় কি দু’বছর পরেই মার্কিন তাবেদার চিয়াং কাইশেক সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে চীনে কমুনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর একমাত্র প্রথম কোরিয়া যুদ্ধে জড়িত হওয়া ছাড়া কোনো প্রতিবেশী দেশে গণতন্ত্র রক্ষা বা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন রোধে নয়া চীনকে কোনো ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। চীন নিজেই কম্যুনিস্ট রাষ্ট্র। ফলে তার কাছ থেকে গণতন্ত্র রক্ষায় তেমন সাহায্য পাওয়ার আশা হয়তো অনেক দেশই করেনি। কিন্তু বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদী নয়া আগ্রাসন রোধে চীন তাদের পাশে দাঁড়াবে। যেমন দাঁড়িয়েছিল সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়ন, এই আশা অনেকেই করেছে।
কিন্তু নয়াচীন নিজের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ছাড়া অন্য কোনো প্রকার নীতি ও আদর্শকে কোনো প্রকার গুরুত্ব দেয়নি। তার তিব্বত গ্রাস, ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধের শত্রুতা, ভারতের সঙ্গে সীমান্ত-বিরোধকে আকস্মিক সশস্ত্র অভিযানে পরিণত করা, কম্বোডিয়ায় গণহত্যাকারী লনলন রেজিমকে সাহায্য দান, পাকিস্তানের সামরিক জান্তার পৃষ্ঠপোষক সাজা, সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নকে কোণঠাসা করার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আঁতাত, জোট নিরপেক্ষ মুভমেন্টে যোগ না দেওয়া, সর্বোপরি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা এবং পাকিস্তানের বর্বর গণহত্যাযজ্ঞে সহায়তাদান, সদ্য স্বাধীন এশিয়ান ও আফ্রিকান দেশগুলোর অনেকগুলোতে বিশ্ব-রাজনীতিতে নয়াচীনের ভূমিকা সম্পর্কে সন্দেহ ও ভীতি সৃষ্টি করেছিলো।
চীন বর্তমানে যতোই সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী হচ্ছে, ততোই আগের আন্তর্জাতিক নীতি অনেকটাই সংশোধন করেছে। কিন্তু সম্প্রসারণবাদী নীতি থেকে সে সরে এসেছে এটা কেউ মনে করতে পারছে না। এখানেই এশিয়া ও আফ্রিকায় মার্কিন আধিপত্যবাদী নীতির সঙ্গে নয়াচীনের সম্প্রসারণবাদী নীতির সাম্প্রতিক বিরোধ এবং ভারত সেখানে আমেরিকার পক্ষপুটে আশ্রয় নিয়ে অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্প্রসারণবাদী নীতিতে চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইছে। আমেরিকা চাইছে এই বিরোধ উস্কে দিয়ে চীনকে ভারতের দ্বারা শায়েস্তা করতে এবং নিজে তার সাফল্য লুটে নিতে। যেমন সে করেছে চীনের সঙ্গে সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নের বিরোধ উস্কে দিয়ে এবং চীনকে সাহায্য-সমর্থন দিয়ে সোভিয়েট ইউনিয়নকে পর্যুদস্ত করার বেলায়। সোভিয়েট ইউনিয়নকে পর্যুদস্ত করার পর আমেরিকার এখন নজর পড়েছে নয়াচীনকে শায়েস্তা করার উপর। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এই ধূর্ত খেলার ফাঁদে ভারত আগে কখনো পা দেয়নি। ষাটের দশকে হিমালয়ান যুদ্ধে চীনের দ্বারা অবমানিত ও পর্যুদস্ত হওয়া সত্ত্বেও নেহেরুর আত্মমর্যাদাশীল রাজনৈতিক নেতৃত্ব দৃঢ়তার সঙ্গে আমেরিকার ফাঁদে পা দিতে রাজি হয়নি। তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন কেনেডি ভারতকে ভয় দেখিয়েছিলেন, চীন আবার ভারতের বিরুদ্ধে পূর্ণ যুদ্ধ (Total war) শুরু করবে। সুতরাং ভারতের উচিত, আমেরিকার সামরিক বলয়ে যোগ দেওয়া। আমেরিকা তাহলে ভারতকে তার ‘আণবিক ছাতার’ (atomic umbralla) নিচে সুরক্ষা দেবে। নেহেরু ঘৃণার সঙ্গে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বলেছিলেন, একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রয়োজনে চীনের সঙ্গে যুদ্ধ করে মরবো, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের কোলে আশ্রয় নেব না।
ভাগ্যের পরিহাস, পঞ্চাশ বছর আগে ভারতের কংগ্রেস সরকারের আত্মগর্বী রাজনৈতিক নেহেরু-নেতৃত্ব আমেরিকার যে পারমাণবিক সহযোগিতা গ্রহণে দৃঢ়তার সঙ্গে অস্বীকার করেছিলেন, ৫০ বছর পর যখন ভারত এশিয়ার দ্বিতীয় সুপার পাওয়ারে পরিণত হতে চলেছে, তখন দিল্লির সেই কংগ্রেস সরকারেরই অরাজনৈতিক নেতৃত্ব (সোনিয়া-মনমোহন সরকার) পরমাণু শক্তি সহযোগিতার নামে আমেরিকার বর্তমান আগ্রাসী আধিপত্যবাদী নীতির সঙ্গে কণ্ঠি বদলে আগ্রহী।
চীন, ব্রাজিল, ইরান, কিউবা প্রভৃতি দেশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আজ ভারতের যেখানে ধ্বংসাত্মক ভয়াবহ মারণাস্ত্র শক্তির অধিকারী আমেরিকার নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার নামক সর্বগ্রাসী আধিপত্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিত ছিলো (যেমন পঞ্চাশের দশকে নেহেরু গড়ে তুলেছিলেন মিসরের নাসের, যুগোশ্লোভিয়ার টিটোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন তৈরি করে), সেখানে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতার নামে সারা এশিয়ার দুয়ার দিল্লি খুলে দিচ্ছে নেহেরু-নীতি বিসর্জন দিয়ে মার্কিন আধিপত্যবাদী নীতির সামরিক অভিযানের মুখে। ফলে গণতন্ত্রের জন্য ভয়াবহ বিপদ সৃষ্টি হয়েছে সারা এশিয়ায়। এমনকি ভারতেও। মিত্রবেশী আমেরিকার ক্রম অনুপ্রবেশে ভারতীয় গণতন্ত্রের দেয়ালেও ফাটল সৃষ্টি হয়েছে এবং বিপদাশঙ্কা দেখা দিয়েছে বাংলাদেশসহ সকল প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্যও।
বাংলাদেশে আমরা  যারা এতোকাল ‘ভারত-প্রেমিক’ বলে পরিচিত ছিলাম, এমনকি ‘ভারতের দালাল’ বলেও গালি সহ্য করেছি, তাদেরও ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি, বিগ বিজনেসের কাছে কংগ্রেসের রাজনৈতিক নেতৃত্বের আত্মসমর্থন, ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন নীতিকে সমর্থন, আফগানিস্তানে মার্কিন সমর-নীতিতে (শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে) সহযোগিতা, বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সমস্যা মেটাতে অনিচ্ছা ও অনাগ্রহ, সর্বোপরি মার্কিন মদদে গুজরাটে নরেন মোদী, পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জি, মধ্য ভারতে আন্না হাজারের মতো যে অপশক্তি গণহিতৈষীর ছদ্মবেশে আত্মপ্রকাশ করছে, তা মোকাবিলায় ভারতীয় গণতন্ত্রের দুর্বলতা শঙ্কিত করে তুলছে। (পরবর্তী অংশ আগামী রবিবার)।
++লন্ডন থেকে ১৭ মে বৃহস্পতিবার, ২০১২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন