রবিবার, ১০ জুন, ২০১২

নোবেলজয়ীর কাছে আমার কিছু সবিনয় নিবেদন


আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
[সম্প্রতি ঢাকার কাগজগুলোতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ ও আমার শংকা’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ বেরিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় ১৫ মে, ২০১২ তারিখে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে তদন্ত করে কোন অনিয়ম হয়ে থাকলে তা দূর করার জন্য সরকারকে সুপারিশ জানাতে যে তদন্ত কমিশন গঠনের ব্যব¯’া করেছে, তাতে ড. ইউনূস তার নিবন্ধটিতে শংকা প্রকাশ করেছেন। আমি তার এই শংকা সম্পর্কে ঢাকার কাগজেই তাকে একটি খোলা চিঠি লিখেছি। ওই চিঠিটা প্রকাশের পর আমার মনে হয়েছে, তার কাছে আমার সব কথা নিবেদন করা হয়নি। তাই এই দ্বিতীয় খোলা চিঠি। (লেখক)]
শ্রদ্ধেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূস
আপনি একজন নোবেল-লরিয়েট। নোবেল পুরস্কার এখন যতই বিতর্কিত হোক, আপনার এই নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিতে বাংলাদেশের আর ১০ জন মানুষের মতো আমারও গর্বিত হওয়ার কথা। কিš‘ আমি গর্বিত হতে পারিনি দুই কারণে। প্রথমত, পুরস্কারটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনি যেভাবে নিজেই ‘অহংকারের এভারেস্টে’ আরোহণ করে এই পুরস্কার ও তার খ্যাতিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে (তখনকার আধাসামরিক শাসনের লক্ষ্য পূরণের যা সহায়ক হতে পারত) ব্যবহার করতে চাইলেন, এমনকি একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিলেন, তখন মনে হয়েছিল, আপনাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। 
দ্বিতীয়ত, গত মহাযুদ্ধের পর থেকেই নোবেল পুরস্কার তার আগের মর্যাদা হারিয়ে একটি বিতর্কিত পুরস্কার। বার্ট্রান্ড রাসেল পঞ্চাশের দশকেই বলেছেন, ‘নোবেল পুরস্কার এখন øায়ুযুদ্ধে পশ্চিমা শিবিরের হাতে একটি মোক্ষম হাতিয়ার। এই পুরস্কারের প্রবর্তক আলফ্রেড নোবেল আজ যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে হয় এই পুরস্কারদান-ব্যব¯’া বাতিল করতেন অথবা এই পুরস্কার থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করতেন।’
রাসেল অত্যুক্তি করেননি। শান্তির জন্য মহাÍা গান্ধী সর্বাগ্রে এই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হননি। বিবেচিত হয়েছেন ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী এক প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশে হয়েছেন আপনি।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘায়েল করার জন্য আমেরিকা øায়ুযুদ্ধে এই নোবেল পুরস্কার এত ন্যক্কারজনকভাবে ব্যবহার করেছে যে, এই পুরস্কারের আগেকার আন্তর্জাতিক ঔজ্জ্বল্য ও মর্যাদা এখন নিষ্প্রভ। সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘায়েল করার পর এখন এই হাতিয়ার ব্যবহার করা হ”েছ নয়াচীনের বির“দ্ধে। নয়াচীনের কমিউনিস্ট শাসন ও সংকুচিত নাগরিক স্বাধীনতার সমাজ ব্যব¯’ার বির“দ্ধে আমেরিকার দ্বারা প্ররোচিত ও উৎসাহিত হয়ে যারাই লেখালেখি করেন, তাদের বেছে নিয়ে নানা পুরস্কার দেয়া হয়। দেয়া হয়েছে নোবেল পুরস্কারও। 
গত বছর চীনের এমন এক সাহিত্যিককে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে এবং তাকে নিয়ে সারাবিশ্বে হইচই ফেলে দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি একজন পশ্চিমা সাহিত্য বিশেষজ্ঞ ও সমালোচক স্বীকার করেছেন, চীনের যে লেখককে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে, তার সাহিত্য উ”চমানের, কিš‘ আন্তর্জাতিকমানের নয়। তাকে মেধা ও মানের জন্য পুরস্কার দেয়া হয়নি, দেয়া হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। এই উদ্দেশ্য কমিউনিস্ট চীনকে বিব্রত করা।
এই একই উদ্দেশ্যে এক সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহিত্যিক বরিস প্যাস্তারনাককে তার ‘ড. জিভাগো’ বইয়ের জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছিল। এই বইটিকে টলস্টয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিসের’ সঙ্গে তুলনা করে বিশ্বব্যাপী দামামা পেটানো হয়েছিল। অথচ টলস্টয় নোবেল পুরস্কার পাননি। যেমন মহাÍা গান্ধী পাননি নোবেল শান্তি পুরস্কার। নোবেল পুরস্কারের আন্তর্জাতিক মর্যাদা বিতর্কিত হওয়ার আগেই বার্নার্ড শ’ এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পরবর্তীকালে মরমী দার্শনিক ও সাহিত্যিক জাঁ পল সার্ত্র এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘এই পুরস্কার নিলে আমি আমার শিল্পীর স্বাধীনতা হারাব এবং আমার মানবতাবাদী চেতনা আহত হবে।’ নোবেল পুরস্কারের বর্তমান স্ট্যাটাস সার্ত্রের এই উক্তি থেকে প্রণিধানযোগ্য। চকচক করলেই তামা যে সোনা হয় না তার প্রমাণ, এই সেদিনের নোবেল বিজয়ী বরিস প্যাস্তারনাক, তার বই ড. জিডাগোর নাম আজ আর কোথাও শোনা যায় না। বিস্মৃতির অন্ধকারে তা ডুবে গেছে। কিš‘ নোবেল প্রাইজ না পেয়েও টলস্টয় ও তার বই ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ দীর্ঘকাল ধরে সারাবিশ্বে আদৃত। টলস্টয় বা øায়ুযুদ্ধের আগে নোবেল প্রাইজ পাওয়া রবীন্দ্রনাথকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কোন প্রচার প্রোপাগান্ডার দরকার হয়নি। তারা নিজের গুণে এবং মাহাÍ্যইে মহীয়ান।
আপনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর বাংলাদেশে যে হইচই সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং আপনি নিজেও ‘আনন্দের এভারেস্টে’ আরোহণ করে হইচই শুর“ করেছিলেন, তা একমাত্র ‘হুজুগে বাঙালির’ দেশেই সম্ভব। আপনার আগে ড. অমর্ত্য সেন নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের লোক। তার এই পুরস্কার পাওয়া নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আদৌ হুজুগ সৃষ্টি করা হয়নি এবং তিনি নিজেও পুরস্কারটি নিজেকে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিকভাবে প্রোমোট করার কাজে লাগাননি। তিনি অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আপনি পুরস্কারটি নিজেকে রাজনৈতিকভাবে প্রোমোট করার কাজে লাগিয়েছেন।
ড. অমর্ত্য সেনের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা নিয়ে তার দেশেও কোন প্রশ্ন ওঠেনি। কিš‘ তার অর্থনৈতিক থিওরি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তার অর্থনীতিবিদ বন্ধুদেরই কেউ কেউ বলেছেন, ড. সেন তার অর্থনৈতিক থিওরিতে এক সময়ের অনুন্নত দেশগুলোতে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির যে প্রধান কারণগুলো দর্শিয়েছেন, তাতে আমেরিকাসহ পশ্চিমা সাবেক ঔপনিবেশিক দেশগুলো খুশি হয়েছে। কারণ, এ দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর শোষণ ও লুণ্ঠনের সরাসরি দায়কে এ থিওরিতে অনেকটাই আড়াল করে ফেলা হয়েছে। অমর্ত্য সেন তাই পুরস্কৃত হয়েছেন।
তবু অমর্ত্য সেন একটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ অর্থনৈতিক থিওরির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কিš‘ শ্রদ্ধেয় ড. ইউনূস, আপনাকে কোন্ থিওরি বা পাণ্ডিত্যের জন্য পুরস্কারটি দেয়া হল? আপনাকেও খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ বলা হয়। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়ার সময় মাস্টার্স ডিগ্রির পরীক্ষাতেও ফার্স্ট হতে পারেননি। হয়েছিলেন আপনার সহপাঠী ও বন্ধু ড. ফখর“দ্দীন আহমদ। তিনি একজন অত্যন্ত ভালো মানুষ। কিš‘ আপনার প্ররোচনায় এক-এগারোর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে গিয়ে তাকে আজ দেশছাড়া হতে হয়েছে। কথা ছিল, সেনা সমর্থিত সরকারের প্রধান আপনিই হবেন। আপনি আরও বড় উ”চাকাক্সক্ষা থেকে গোবেচারা ড. ফখর“দ্দীনকে স্টকিং হর্স হিসেবে ব্যবহার করে চমৎকারভাবে নিজেকে বাঁচিয়েছেন। না হলে আপনাকে নোবেল প্রাইজ দেয়ার আসল উদ্দেশ্য তখনই জানাজানি হয়ে যেত।
শ্রদ্ধাভাজন ড. ইউনূস, আমার এই খোলাচিঠিতে আপনার প্রতি কোন প্রকার রূঢ়তা প্রকাশ পেয়ে থাকলে আমাকে ক্ষমা করবেন। বর্তমানে আপনার ও আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে যা চলছে তা দেশের জন্য ভয়ানক বিপদ ডেকে আনতে পারে। এ বিপদ এড়ানোর জন্যই অকপটে কিছু কথা বলা দরকার মনে করছি। আমার বক্তব্য ও বিশ্লেষণে যদি কোন ভুল-ভ্রান্তি থাকে, তাহলে অবশ্যই তা খণ্ডন করবেন। আপনি একজন বিশ্ববরেণ্য মানুষ। আমার মতো এক নগণ্য সাংবাদিকের কথার জবাব দিতে আপনাকে স্বয়ং নামতে হবে না। আপনার চারপাশে আমার চেয়ে শক্তিশালী অনেক লেখক, সাংবাদিক, মুগ্ধ ভক্তের দল আছেন। আছে দুটি জবরদস্ত মিডিয়া। আপনি চাইলেই তারা আপনার হয়ে আমার বির“দ্ধে লাঠির বদলে তলোয়ার ঘোরাতে শুর“ করবে। আমি অবিনয়ী কথা বলে থাকতে পারি, কিš‘ অসত্য বলে থাকলে খণ্ডিত হোক তা চাই।
আপনাকে অর্থনীতিবিদ বলা হয়। সামাজিক ব্যবসা, গ্রামীণ ব্যাংক ইত্যাদি যে কোন বিষয়ে আপনার ‘উদ্ভাবনা বুদ্ধিকে’ ‘জগজ্জয়ী প্রতিভা’ আখ্যা দিয়ে আপনাকে নোবেল পুরস্কার দেয়া যেত। পশ্চিমারা বিশেষ করে আমেরিকা দিতে চাইলে তা ঠেকায় কে? সুতরাং এসব বিষয়ে আপনাকে নোবেল পুরস্কার না দিয়ে নোবেল শান্তির পুরস্কার কেন দেয়া হল এটা ডে ওয়ান থেকে আমার মনে প্রশ্ন। মহাÍা গান্ধী শান্তি ¯’াপনের লক্ষ্যে ইউরোপের বোয়ার যুদ্ধে ভলান্টিয়ার হয়েছিলেন। আপনাকে কোন যুদ্ধে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ভলান্টিয়ার হওয়া দূরের কথা নিজের ঘরের কাছে পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদনে বা সেই যুদ্ধে রক্তপাত বন্ধ করতে সামান্য ভূমিকাও গ্রহণ করতে দেখা যায়নি।
তাহলে কি গরিবকে চড়া সুদে ঋণ দেয়াটা শান্তি প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় অবদান? এ প্রশ্নের জবাব যদি হ্যাঁ সূচক হয়, তাহলে অবিভক্ত বাংলার একেবারে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ধনী-গরিব সব মানুষকে বিনা গ্যারান্টিতে চড়া সুদে ঋণ দেয়ার জন্য কাবুলিরা যে বিরাট নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল, সেই কাবুলিওয়ালাদের শান্তি পুরস্কার দেয়া উচিত ছিল। সে সময় অত্যাচারী জমিদারদের খাজনা পরিশোধের জন্য গরিব চাষীরা কাবুলিওয়ালাদের কাছ থেকেও চড়া সুদে টাকা কর্জ নিত। তার পর সেই সুদ দিতে না পারলে কাবুলিদের হাতে তাদের ভয়াবহ নির্যাতনের অন্ত থাকত না। গ্রামীণ ব্যাংকের সুদ আদায়ে এ কাবুলি পদ্ধতিকে মডেল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বলে শুনেছি। অনেক ঋণগ্রহীতা নাকি আÍহত্যাও করেছেন।
কেউ কেউ বলেছেন, সাহিত্যে, শিল্পে, বিজ্ঞানে, চিকিৎসাশাস্ত্রে বিরাট অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে আপনার কোন অবদান খুঁজে না পেয়েই আপনাকে নাকি শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়েছে। আপনাকে তখন আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোর বিশেষ স্বার্থে নোবেল পুরস্কার দিতেই হবে, সুতরাং শান্তির মতো নিরাকার বিষয়টি বেছে নেয়া হয়েছে। আপনাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া ঠিক হয়েছে কিনা, আওয়ামী লীগের এক বেকুব মন্ত্রীর মতো সেই প্রশ্ন আমি তুলছি না, বরং নোবেল পুরস্কার দেয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে এই বেকুব মন্ত্রী যে অর্বাচীন কথা বলেছেন, তাতে আমি লজ্জাবোধ করেছি। আপনার নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা সম্পর্কে আমার কোন প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন তুলছি এই পুরস্কারটি আপনাকে দেয়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে। এটা কি একটা কাকতালীয় ব্যাপার নয় যে, আপনি নোবেল পুরস্কার পেলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে সেটিকে মূলধন করে বাংলাদেশে হঠাৎ রাজনীতিকের ভূমিকায় নেমে এলেন? এবং তার আগে দেশে সেনা তাঁবেদার অগণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার কাজে সমর্থন ও সহায়তা জোগালেন? কোথায় আপনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার গৌরব ও মর্যাদাকে কাজে লাগিয়ে দেশে গণতন্ত্র রক্ষায় মহৎ ভূমিকা নেবেন, না আপনি গেলেন এক-এগারোর তথাকথিত সিভিল সরকারকে ক্ষমতা গ্রহণে সহায়তা দিতে এবং আপনার মনোনীত ব্যক্তিকেই সেই সরকার প্রধানের পদে বসাতে। আপনার নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় আমার গর্বিত বোধ না করার দ্বিতীয় কারণ এটি।
বাংলাদেশের তখন বড় দুর্দিন। দেশটির রাজনীতিকে শুদ্ধকরণের নামে (যে শুদ্ধিকরণের আপনি একজন বড় সমর্থক) সেনাবাহিনী সামনে শিখণ্ডী সিভিল সরকার খাড়া করে ক্ষমতা দখল করেছে। দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের নেত্রী জেলে। কারাবন্দি অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী। অত্যাচারের স্টিমরোলার নেমে এসেছে দেশের রাজনীতির ওপর। উদ্ভাবিত হয়েছে মাইনাস টু থিওরি। এই থিওরি বাস্তবায়নে সরবে সমর্থন জানা”েছ আপনার পৃষ্ঠপোষিত দুটি পত্রিকাই। 
শোনা গেল, এই মাইনাস টু থিওরির আসল উদ্ভাবক এবং সমর্থক পশ্চিমা দাতা দেশগুলো এবং তাদের অনুগৃহীত একটি বর্ণচোরা দেশী সুশীল সমাজ। আগে পশ্চিমা দেশগুলোÑ বিশেষ করে আমেরিকা অনুন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে গণতন্ত্র অকার্যকর এই ধুয়া তুলে সামরিক বাহিনী থেকে একজন ত্রাণকর্তা (ংধারড়ঁৎ) আবিষ্কার করে তাকে ক্ষমতায় বসাতেন। এখন কৌশল পাল্টে একজন ‘সিভিল ত্রাণকর্তা’ আবিষ্কার করে তাকে ক্ষমতায় বসান। যেমন, আফগানিস্তানে কারজাই এবং ইরাকে তারিকি। বাংলাদেশেও তখন আপনাকেই নাকি দেশটির সিভিল ত্রাণকর্তা হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিল। এবং সে জন্যই নাকি আপনাকে বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ও মর্যাদাবান করে তোলার উদ্দেশ্যে হয়েছিল তড়িঘড়ি এ নোবেল শান্তি পুরস্কার দানের ব্যব¯’া। 
এই শোনা কথা কতটা সঠিক তা আমি জানি না। কিš‘ নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আপনি দেশবাসীকে ‘আনন্দের এভারেস্ট চূড়ায়’ আরোহণের আহবান জানিয়ে যে কাজটি করলেন, তাতে এই শোনা কথায় বিশ্বাস ¯’াপন করতে ই”েছ হয়। আপনি পুরস্কারটি বগলদাবা করে দেশে ফিরে এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়েই নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিলেন। তখন বাংলাদেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ, রাজনৈতিক তৎপরতা আরও বেশি নিষিদ্ধ। ঠিক এই সময় আপনি কেমন করে দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দেন, প্রকাশ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা শুর“ করেন, সর্বোপরি এই তৎপরতা চালাতে এক-এগারোর সেনা তাঁবেদার সরকার আপনাকে সুযোগ ও সহায়তা দেন তা এক বিস্ময়কর ব্যাপার।
দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের নেত্রীই তখন কারাবন্দি। অসংখ্য রাজনৈতিক নেতাকর্মী জেলে। সারাদেশে ভীতির রাজত্ব। এমন সময় নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির খ্যাতি এবং আন্তর্জাতিক প্রভাবকে দুই নেত্রীর মুক্তি এবং দ্র“ত ভীতির রাজত্ব অবসানের কাজে না লাগিয়ে সেই প্রভাবকে কাজে লাগালেন নিজেকে রাজনৈতিক নেতা সাজানোর চেষ্টায় এবং দেশী-বিদেশী চক্রান্ত-জাত মাইনাস টু থিওরি বাস্তবায়নে সহায়তাদানের কাজে। নোবেল পুরস্কারকে মূলধন করে এটা তো ছিল ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার চেষ্টা করার মতো। কিš‘ আপনি হয়তো অত্যন্ত ঠেকে বুঝেছেন, প্রকৃত জনসেবার ট্র্যাক রেকর্ড না থাকলে এবং জনজীবনের শিকড়ে সমর্থন না থাকলে কেবল পুরস্কার, পদক ও বিদেশী মুরব্বিদের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক নেতা হওয়া যায় না। আপনি বুদ্ধিমান মানুষ। এটা বুঝতে পেরেই রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়েই দ্র“ত লক্ষ্য থেকে প্র¯’ান করেছেন।
আপনার সমর্থকরা প্রচার চালা”েছন এবং লন্ডনের প্রভাবশালী দ্য ইকনোমিস্ট কাগজকে কব্জা করে কাগজটি দ্বারা প্রচার চালানো হ”েছ, শেখ হাসিনা আপনাকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন এবং আপনার নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় ঈর্ষান্বিত। ইকনোমিস্টের সম্প্রতি লেখাগুলোর নেপথ্যে বসে যারা আপনার হয়ে নাটাই ঘোরা”েছন, তারা কাগজটিকে দিয়ে এমন কথাও বলিয়েছেন যে, ‘হাসিনা সরকার গ্রামীণ ব্যাংকটিকে গ্রাস করতে চায়।’ আর কেউ না জানুক, আপনি জানেন, দুটি অভিযোগই সঠিক নয়। সরকারি অর্থ সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক সরকার গ্রাস করে কীভাবে? শেখ হাসিনা নিজে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার জন্য মনে মনে খুবই আশা পোষণ করতে পারেন, কিš‘ বাংলাদেশের একজন সম্মানিত নাগরিক নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় মোটেই ঈর্ষান্বিত হননি। বরং খুশিই হয়েছিলেন। বাঙালিদের নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় তিনি আনন্দিত ও গর্বিত না হলে আরেক বাঙালি নোবেলজয়ী ড. অমর্ত্য সেনকে বারবার ঢাকায় ডেকে এনে সম্মান দেখাতেন না। আপনাকেও তিনি সম্মান দেখাতেন এবং অমর্ত্য সেনের মতোই বারবার কাছে টেনে নিতেন, যদি নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আপনার চেহারাটি বেরিয়ে না আসত। এই চেহারাটি একজন ক্ষমতালোভী ব্যবসায়ীর, নোবেলজয়ী মনীষীর নয়।
আপনি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চাইলে তার ভীত হওয়ার কারণ ছিল না এবং এখনও নেই। আপনার আগে ড. কামাল হোসেনের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতির অধিকারী অনেক নেতার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয়েছেন তিনি এবং যুদ্ধে নামতে ভয় পাননি। এক্ষেত্রে আপনাকে ভয় পাবেন কেন? রাজনীতির মাঠে তিনি আরেকজন প্রতিদ্বন্দ্বীর সম্মুখীন হতেন মাত্র। কিš‘ আপনি নোবেল পুরস্কার ও বিদেশী মদদকে কাজে লাগিয়ে কেবল হাসিনা বা আওয়ামী লীগের বিরোধিতায় নামেননি, নামলে কথা ছিল না, আপনি নেমেছেন দেশের গণতন্ত্রবিরোধী চক্রগুলোকে মদদ জোগাতে। মাইনাস টু থিওরির বাস্তবায়ন এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে পশ্চিমা দাতা দেশগুলোর স্বার্থপূরণের কাজে। আপনার রাজনৈতিক দল গঠন ছিল একটি ভাঁওতা। আপনার লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে রাজনীতিবর্জিত অগণতান্ত্রিক ব্যব¯’ার দিকে ঠেলে নেয়া।
ফলে শুধু শেখ হাসিনা নন, দেশের বাম ও গণতান্ত্রিক দল এবং বুদ্ধিজীবীরাও (আপনার পেটোয়া বুদ্ধিজীবীরা ছাড়া) আপনার ভূমিকা সম্পর্কে সন্ধিগ্ধ ও সতর্ক হয়েছেন। আপনি নোবেল পুরস্কার এবং গ্রামীণ ব্যাংকটিকেও আপনার রাজনৈতিক উ”চাকাক্সক্ষা ও স্বার্থ পূরণের উদ্দেশ্যে কি কাজে লাগাতে চাননি? এখন যদি গ্রামীণ ব্যাংকের ৩৪ বছরের কার্যকলাপ সম্পর্কে একটি সুষ্ঠু তদন্ত হয়, তাহলে হয়তো অনেক গুর“তর অনিয়ম বের হয়ে আসবে। আপনি যে সেই ভয়ে ভীত, আপনার ৩১ মে তারিখে ঢাকার কাগজগুলোতে প্রকাশিত ‘গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ এবং আমার শংকা’ শীর্ষক প্রবন্ধটিতে তা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে।
আর এই ভয় থেকে আপনি হিলারি ক্লিনটনকে দিয়ে আবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি লিখিয়েই ক্ষান্ত হননি, আপনি ছুটে গেছেন ব্রিটেনের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আলস্টার বার্টের কাছে। তাকে দিয়ে আবার বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টিমূলক উক্তি করিয়েছেন। এটা একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশী হস্তক্ষেপ ডেকে আনা। এ সম্পর্কে বাংলাদেশেরই একজন কলামিস্ট ও গবেষক রতন তনু ঘোষ সম্প্রতি তার এক লেখায় মন্তব্য করেছেন, ‘একজন নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব রাজনীতি সম্পর্কে তার অভিমত দিতে পারেন। কিš‘ দেশের রাজনীতিকে বিদেশী হস্তক্ষেপের মুখোমুখি দাঁড় করাবেন, এটা কারও কাম্য নয়।’ এই মন্তব্য একজন দেশপ্রেমিক বাঙালির। আমার ধারণা গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে তদন্ত কমিশন গঠনেই আমাদের নোবেলজয়ী এত ভীত হয়ে পড়েছেন।
লন্ডন ।। ১০ জুন ।। রোববার ২০১২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন