বৃহস্পতিবার, ১৪ জুন, ২০১২

নতুন করে রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টির উদ্দেশ্য কি?



 আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী  
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যাটি বাংলাদেশের নিজস্ব সমস্যা নয়, এটি প্রতিবেশী মিয়ানমারের সমস্যা। সেখানে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের উপর, যারা ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান, অত্যাচার শুরু হওয়ায় এবং তারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হওয়ায় নিরাপদ আশ্রয় লাভের জন্য বাংলাদেশের সীমান্তে ঢুকে পড়ছে। সমস্যাটি আজকের নয়। বহু বছর আগেও ৫ লাখের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে ঢুকেছিলো। সম্ভবত: বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে তাদের সংখ্যা এখন ২৫ হাজারের মতো। বাকি অনেকেই নানাভাবে বাংলাদেশের জনজীবনে মিশে গেছে। বাংলাদেশের পাসপোর্ট সংগ্রহ করে বিদেশে চলে গেছে। এরা বাংলাদেশের সমাজ জীবনে রাজনৈতিক এবং সামাজিক দু’ ধরনের উত্পাতই সৃষ্টি করেছিল। যে উত্পাত  থেকে বাংলাদেশ এখনো মুক্ত হয়নি। বিপন্ন শরণার্থীদের আশ্রয় ও নিরাপত্তা দেয়া মানবতার দাবি। বাংলাদেশ নিজস্ব আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যায় বিব্রত থাকায় এবং এক বিরাট সংখ্যক আটকে পড়া পাকিস্তানির (বিহারি) সমস্যার বেড়াজাল থেকে এখনো সম্পূর্ণ মুক্ত হতে না পারায় নতুন করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়দানের গুরুতর চাপ বহন করা তার পক্ষে অসম্ভব। কয়েক লাখ আটকে পড়া পাকিস্তানির সমস্যা থেকে মুক্ত হওয়ার আগেই আবার কয়েক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর চাপ বহন করা বাংলাদেশের দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য ছিলো কষ্টকর।
তথাপি মিয়ানমারের রাখাইন বা আরাকান অঞ্চলের  রোহিঙ্গা পরিচয়ধারী মুসলমানেরা আগেও যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হয়ে দলে দলে সীমান্ত পেরিয়ে ঢোকে তখন তাদের আশ্রয় দিতে বাংলাদেশ বাধ্য হয়েছিলো। অনেকেরই ধারণা, মিয়ামনারের সামরিক জান্তা দেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বিভক্তি সৃষ্টির জন্য বৌদ্ধ ও মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ উস্কে দিয়ে এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত করেছিলো। এই ধারণাটির সত্যতা প্রমাণিত হয় বর্তমানে দাঙ্গা আবার শুরু হওয়ায় মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের উক্তি থেকে। বহির্বিশ্বের চাপে এবং দেশের ভেতরে গণতান্ত্রিক আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠায় অং সান সূ চিকে মুক্তি দিয়ে পার্লামেন্টে যোগদানের সুযোগ দিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে বাধ্য হওয়ার পর সামরিক জান্তা সেই প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার জন্য এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করবে বৈকি। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, “এই দাঙ্গা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়ার কাজকে ব্যাহত করবে।”
তাই যদি হয়, সামরিক জান্তা এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কঠোর হাতে বন্ধ করার ব্যবস্থা করছেন না কেন? খবরে জানা যায়, মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের সহায়তাতেই রোহিঙ্গারা আবার বাংলাদেশে ঢুকছে। তা থেকে কি এই সন্দেহই দৃঢ় হয় না যে, নিজ দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করা এবং বাংলাদেশে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির লক্ষ্যে মিয়ানমারের শাসক সামরিক জান্তা এই নতুন শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টি করতে চাইছেন?
ইতিপূর্বেও তারা এই সমস্যা সৃষ্টি করেছেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার রোহিঙ্গাদের কোনো প্রকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে বাংলাদেশে পালাতে তাদের বাধ্য করেছিলেন। বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়েছে। এটা দুর্গত মানবতার প্রতি প্রতিবেশীসুলভ দায়িত্ব পালন। কিন্তু তারপরই শুরু হয়েছে বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে এক ভয়াবহ অস্থিরতা। রোহিঙ্গা যুবক-যুবতীরা দেশে ফিরে যেতে না পেরে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে নানা প্রকার সামাজিক অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে বাংলাদেশের জামায়াত সংশ্লিষ্ট জঙ্গি গ্রুপগুলো এই রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে তাদের ক্যাডার সংগ্রহ শুরু করে। ফলে রোহিঙ্গা সমস্যায় বাংলাদেশের জন্যও এক বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকার এই পরিস্থিতি সামাল দিয়ে উঠতে না উঠতেই আবার মিয়ানমারে নতুন করে রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টি করা হয়েছে। এবারের হাসিনা সরকার শরণার্থী সমস্যায় একটা নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের গ্রহণে অসম্মতি জানিয়েছেন। এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের আর কিছুই করার নেই। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সামাজিক ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন দ্বারা অশুভ উদ্দেশ্য সাধনের কাজে লাগাবার জন্য একাধিক অশুভ মহল যে  চক্রান্তের জাল বিস্তার করেছিলো, তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দিলে বাংলাদেশ চরম সর্বনাশের সম্মুখীন হবে।
এই কথাটি জানা থাকা সত্ত্বেও জাতিসংঘের শরণার্থী সংক্রান্ত হাইকমিশন বাংলাদেশকে নতুন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছেন। বাংলাদেশ সরকার দৃঢ়তার সঙ্গে তাতে অসম্মতি জানিয়ে ভালো করেছেন। একটি নৈতিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজের দেশের ভেতরে যে বিপজ্জনক সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হতো সেটি হাসিনা সরকার ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছেন। জাতিসংঘের শরণার্থী হাইকমিশনের উচিত মিয়ানমারের সামরিক জান্তার উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা, যাতে তারা এই শরণার্থী সমস্যাকে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজকে বিলম্বিত করার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে। অন্যদিকে এই শরণার্থীদের অবিলম্বে দেশে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ দিয়ে আর্তমানবতার প্রতি দায়িত্ব পালন করে। বাংলাদেশের ন্যূব্জ ঘাড়ে এই বোঝা চাপানো জাতিসংঘের উচিত নয়।
অতীতে দুই দুইবার বাংলাদেশের ঘাড়ে এই শরণার্থী সমস্যার বোঝা রাজনৈতিক অশুভ উদ্দেশ্যে চাপানো হয়েছে। দুই দুইবারই বিপন্ন মানবতা রক্ষা ও অত্যাচারিত মুসলমানদের রক্ষার ধুয়া তোলা হয়েছে। অধিকাংশ সময় দেখা গেছে, শাসক শক্তির প্রশ্রয় ও মদদ এবং অশুভ উদ্দেশ্য ছাড়া সাম্প্রদায়িক বিরোধ কখনো মাথাচাড়া দিতে পারে না। ভারতের গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরপশু নরেন মোদীর প্রত্যক্ষ মদদ ছাড়া এমন নৃশংস মুসলমান নিধনযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হতে পারতো না। একথা আজ ওপেন সিক্রেট। মিয়ানমারেও রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টির মূলে ছোটখাটো অনেক কারণ ছিলো। কিন্তু বড় কারণই ছিলো, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বিভক্তি সৃষ্টির জন্য ইয়াঙ্গুনের সামরিক জান্তার চক্রান্ত।
তাদের চক্রান্তের সঙ্গে আবার বাংলাদেশের জিয়াউর রহমানের সরকার এবং পরবর্তীকালের খালেদা জিয়ার সরকারের উদ্দেশ্য সম্ভবত  মিলে গেছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রথম দফা বাংলাদেশে আগমন ঘটে ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে। দ্বিতীয় দফা আগমন করে ১৯৯২ সালে খালেদা জিয়ার আমলে। বিপন্ন ইসলাম এবং আক্রান্ত মুসলমানদের রক্ষার নামে এই রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে ঘাঁটি গাড়তে দেওয়া হয়। এদের  যথাসময়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা না করে বাংলাদেশের জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো বিশেষ করে জামায়াতকে এদের মধ্য থেকে ক্যাডার সংগ্রহের সুযোগ দেওয়া হয়।
অনেক রোহিঙ্গা যুবক বাংলাদেশে আসতে ইচ্ছুক ছিলো না। তাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠিয়ে চাকরি পাওয়ার বিরাট প্রলোভন দেখিয়েও নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী এক বিরাট সংখ্যক রোহিঙ্গা এখন সউদি আরবে। তাদের অনেকের সামাজিক অপরাধ ও দুষ্কর্মের দায় ও দায়িত্ব বাংলাদেশের ঘাড়ে বর্তায়। হাসিনা সরকারের সামনে এখন বিরাট সমস্যা, এদের আশ্রয় না দিলে আর্ত-মানবতা ও বিপন্ন মুসলমানদের এই  সরকার রক্ষা করছে না বলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শ্লোগান তোলা হবে। অন্যদিকে এই শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া হলে বাংলাদেশে যে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হবে তার সুযোগ নেবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিরোধী অশুভ চক্রগুলো- এমনকি ইসলামের লেবাসধারী জঙ্গিরাও।
এই অবস্থায় বাংলাদেশে আবার রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টির পুরনো খেলার পুনরাবৃত্তি ঘটতে না দিয়ে এবং কঠোর মনোভাব নিয়ে হাসিনা সরকার অত্যন্ত প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। অবশ্যই মিয়ানমারের এক বিপুল জনগোষ্ঠীকে সাম্প্রদায়িকতার দানবের তান্ডব থেকে রক্ষার মানবিক দায়িত্বটির প্রশ্নও এখানে জড়িত। এই ব্যাপারে দায়িত্ব পালনের জন্য জাতিসংঘ শরণার্থী হাইকমিশনকে মিয়ানমারের উপর কঠোর চাপ দিতে হবে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের বাসিন্দা এবং তাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নেওয়া এবং নিরাপদ পুনর্বাসনের দায়িত্ব মিয়ানমার সরকারের। এই দায়িত্ব যাতে তারা পালন করে, সে জন্যে দেশটির সরকারের উপর কঠোর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে। বাংলাদেশের দরোজা এই শরণার্থীদের জন্য বার বার খুলে দেওয়া এই সমস্যা সমাধানের সঠিক পথ নয়। খুলে দিলে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এবং বাংলাদেশের জঙ্গি ও অশুভ রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর অশুভ উদ্দেশ্য পূরণের কাজেই সাহায্য জোগানো হবে, যা হবে বাংলাদেশের নিজের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক।
লন্ডন ১৪ জুন, বৃহস্পতিবার, ২০১২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন