বুধবার, ১৩ জুন, ২০১২

‘বহ্বাড়ম্বরে লঘুক্রিয়া’

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী


যাক, এগারোই জুন তারিখটি বাংলাদেশে ভালয় ভালয় কেটে গেছে। সরকারকে দাবি মেনে নেওয়ার আলটিমেন্টাম দেওয়ার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর বিএনপি যে বিক্ষোভ মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছিল তাতে এবার তেমন কোন জ্বালাও পোড়াওর ঘটনা ঘটেনি। কোন নিরীহ রিকশাঅলা বা ঘুমন্ত বাস ড্রাইভারকে আগুনে পুড়ে মরতে হয়নি। বিএনপি ইচ্ছে করে এটা করেনি তা নয়। এবার করার ক্ষমতা ছিল না। যারা এটা ঘটাবেন, তাদের পালের গোঁদারা এখন জেলে। বাংলাদেশের রাজনীতি যারা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেন, আমার তেমন এক বন্ধু বলেছেন, ‘কয়েকজন নেতা গ্রেফতার হলেই যে দলের আন্দোলন করার ক্ষমতা থাকে না, তাদের ভবিষ্যত কোথায়?’ 
আন্দোলনের ক্ষমতা না থাকলেও বিএনপি আস্ফালন করার ক্ষমতা হারায়নি। এগারোই জুনের মহাসমাবেশেও স্বয়ং নেত্রী স্বভাবসুলভ তর্জন গর্জন করেছেন এবং বলেছেন, সামনে পবিত্র রমজান মাস, এ সময় হরতালসহ আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচী দেওয়া হলে জনগণের কষ্ট হবে, সেজন্য রমজানের পর কঠোর কর্মসূচী নিয়ে তিনি আবির্ভূত হবেন। জনগণের কষ্টের কথা ভেবে বেগম জিয়ার হৃদয় মায়ের হৃদয়ের চাইতেও বেশি উদ্বেলিত, একথা জেনে আমার মতো অনেকেই মজা পাবেন। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, “মায়ের চাইতে যার দরদ বেশি তার নাম ডাইনী।” বাংলাদেশে এই ‘ডাইনী-রাজনীতি’র খেলা সাধারণ মানুষ অনেক দেখেছে। সুতরাং এখন এই কপটদরদে তাদের মন গলবে না। বিএনপির আন্দোলন মানেই যে ভাঙচুর, জ্বালাও পোড়াও এবং নিরীহ মানুষ হত্যা একথাটা এখন সর্বজনবিদিত।
অথচ বর্তমান সরকারের গত সাড়ে তিন বছরের ব্যর্থতা পানি, গ্যাস, বিদ্যুত, যানজট, গুম, হত্যা, সন্ত্রাস ইত্যাদি নিয়ে বিএনপি চাইলে একটি সুষ্ঠু, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারত। এজন্য প্রথমেই তাদের দরকার ছিল সংসদে যোগদান। ব্রুট মেজরিটির অধিকারী ক্ষমতাসীন সরকার সংসদে তাদের কথা শুনত না, তাতে কি? সাংসদ হিসেবে বিরোধীদলীয় নেতারাও বেতন ভাতা খান, অন্তত সেটা হালাল করার জন্য জনপ্রতিনিধিত্বের ভূমিকা পালনে সংসদের ভিতরে তাদের সোচ্চার হওয়া উচিত ছিল। সেই সঙ্গে সংসদের বাইরেও জনসমর্থনপুষ্ট আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করা। তাতে শুধু শহুরে নাগরিকেরা নন, গ্রামের মানুষও ধীরে ধীরে এসে বিরোধী দলের আন্দোলনের ছাতার নিচে জমায়েত হতো। 
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বা সরকার যতই বলুন, তারা গ্রামবাংলায় জনপ্রিয় এবং কৃষি ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য বিরাট; এই দাবি এক শ’ ভাগ ধোপে টেকে না। কৃষির বাম্পার ফলন হয়েছে বটে, কিন্তু কৃষক চাল বা ধান বেচে উৎপাদন খরচাও তুলতে পারে না। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষা ক্ষেত্রে একটি অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন, তিনি বিনামূল্যে স্কুল মাদ্রাসার সকল শিক্ষার্থীর হাতে পাঠ্যপুস্তক তুলে দিয়েছেন। কিন্তু দেশের বিরাট সংখ্যক প্রাথমিক স্কুলঘরের খড়ের চালাও নেই। রোদ বৃষ্টি মাথায় শিশুদের খোলা আকাশের নিচে বসে লেখাপড়া করতে হয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় যত নরনারীর মৃত্যু হয়, পাকিস্তানে ন্যাটোর ড্রোন হামলাতেও তত লোকের মৃত্যু হয় কিনা সন্দেহ। ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার পেছনে না হয় রাজনৈতিক রহস্য রয়েছে ধরে নিলাম। কিন্তু সাগর-রুনির হত্যাকা-ের কিনারা এত দীর্ঘদিনেও যদি পুলিশ-র‌্যাব, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো করতে না পারে, তাহলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার গদিতে কি করে এখনো বহাল থাকেন?
ফিরিস্তি বাড়াবো না। দেশে আন্দোলন করার মতো ইস্যুর অন্ত নেই। বিএনপি এসব ইস্যুর কথা মুখে বলে। কিন্তু তাদের আন্দোলনের আসল ইস্যু এসব নয়। ক্ষমতা হারানোর পর কিছুদিন নিশ্চুপ ও নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকতে বাধ্য হওয়ার শেষে খালেদা জিয়া আবার যখন রাজনীতিতে সক্রিয় হলেন, তখন থেকেই তার তথাকথিত আন্দোলনের মূল লক্ষ্য বিভিন্ন দুর্নীতির মামলা থেকে নিজেকে এবং বিভিন্ন দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের মামলা থেকে পুত্র তারেক রহমানকে বাঁচানো। এই ইস্যুটির সঙ্গে পরে যুক্ত হয়েছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তিদানের চেষ্টা বানচাল করা।
দেশের সচেতন মানুষের কাছে এটা এখন খুবই স্পষ্ট যে, তাদের দাবি-দাওয়া দুঃখ কষ্ট সমস্যা বিএনপির কাছে মুখ্য বিষয় নয়। তারা জনগণের দুঃখ কষ্ট দাবি-দাওয়া নিয়ে জনগণকে সাথে করে আন্দোলনে নামতে মোটেই আগ্রহী নয়। তারা মাঠে নামার সময় মুখে এই ইস্যুগুলোর কথা বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করেন দলে টানার জন্য। তাদের আসল ইস্যু তারেক বাঁচাও, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাও এবং বর্তমান সরকারকে মেয়াদ শেষ করতে না দিয়ে ক্ষমতা থেকে টেনে নামাও। এই ইস্যুগুলোর সঙ্গে বর্তমানে আরেকটি ইস্যু যোগ হয়েছে, ড. ইউনূসকে বাঁচাও (গ্রামীণ ব্যাংক সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের তদন্ত থেকে)।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের প্রধান কর্মসূচী ছিল বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচার ঠেকানো এবং শাস্তি থেকে তাদের বাঁচিয়ে জেল থেকে বের করতে না পারলেও সেখানে তাদের ফাইভস্টার হোটেলের আরাম আয়েশে রাখা। শেষ পর্যন্ত সেই চেষ্টা তাদের সফল হয়নি। এখন বিরোধী দল হিসেবে থাকা অবস্থায় তাদের দ্বিতীয় প্রধান লক্ষ্য ’৭১-এর নারীঘাতী শিশুঘাতী বর্বর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানো। হালে আবার ‘ইউনূস বাঁচাও’ কর্মসূচী তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
ফলে জনসমর্থন পুষ্ট আন্দোলন বিএনপি তৈরি করতে পারছে না। দেশের মানুষ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে বা ড. ইউনূসকে বাঁচাতে রাজপথে আন্দোলনে নামতে উৎসাহী নয়। বিএনপিকে তাই আন্দোলন করার বদলে আরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টায় নামতে হয়েছে। হাসিনা সরকারও বুঝে শুনেই হার্ডলাইনে গেছেন। কথায় বলে ‘যেমন কুকুর, তেমন মুগুর’। প্রবাদটা আমরা না চাইলেও বাংলাদেশে এবার ফলে গেছে। ১১ জুন বিএনপিকে ‘নিরামিষ মহাসমাবেশের’ মধ্যেই দায়িত্ব পালন শেষ করতে হয়েছে।
বিএনপির বর্তমান ধারাবাহিক আন্দোলনের মূল লক্ষ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় এবং তাদের ধৃত নেতাদের মুক্তি অর্জন করা নয়; লক্ষ্য সন্ত্রাস-দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত তারেক রহমানের বিচার ও শাস্তি ঠেকানো এবং তাকে গলায় মালা দিয়ে দেশে ফিরিয়ে এনে একেবারে ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা করা। তার প্রমাণ মেলে গত ১১ জুনের সমাবেশে বিএনপির অধিকাংশ কর্মী, ভাড়াটিয়া কর্মীর টি শার্টের ছবিতে। শার্টের দুই পকেটের একটিতে জেনারেল জিয়া এবং অন্যটিতে খালেদা জিয়ার ছবি ছোট করে ছাপা। কিন্তু মাঝখানে বিশাল করে তারেক রহমানের ছবি। ‘বাঁশের চাইতে কঞ্চি দড়’ এই প্রবাদটি যে অসত্য নয়, মহাসমাবেশের মহাকর্মীদের বুকে টিশার্টের ছবি দেখে তা বোঝা যায়।
বিএনপির আন্দোলনের আসল কর্মসূচীতে যে এখন ‘ইউনূস-বাঁচাও’ ইস্যু অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তা বোঝা যায় তাদের কথাবার্তা শুনলে এবং কাজ কারবার দেখলেই। গ্রামীণ ব্যাংকে নানা অনিয়মের অভিযোগে এবং শীর্ষ পদে থাকার মেয়াদ শেষ হওয়ায় ড. ইউনুসকে সরকার ব্যাংকের প্রধানের দায়িত্ব পালন থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। সরকারী অর্থসাহায্যে প্রতিষ্ঠিত একটি ব্যাংক সম্পর্কে এই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ সরকারের এখতিয়ারভুক্ত। সরকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ড. ইউনূস সুপ্রিমকোর্টে মামলা করেছিলেন, তাতেও তিনি হেরেছেন। এখন তিনি দেশী বিদেশী চাপ সৃষ্টি দ্বারা সরকারকে কাবু করে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্তৃত্ব আবার ফিরে পেতে চাইছেন। তার সম্ভবত ভয়, গ্রামীণ ব্যাংকের চৌত্রিশ বছরের কার্যকলাপ সম্পর্কে সরকার যে তদন্ত কমিশন নিযুক্ত করেছে, সেই তদন্তে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসতে পারে।
ড. ইউনূস যদি গ্রামীণ ব্যাংকে তার চৌত্রিশ বছরের একচ্ছত্র রাজত্বকালে কোন অন্যায় অনিয়ম না করে থাকেন, তাহলে তো এই তদন্তে তার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এখন প্রশ্ন, তিনি এই তদন্তে (যা এখনো আরম্ভ হয়নি) এত ভয় পেয়েছেন কেন এবং এই তদন্ত বন্ধ করার জন্য এত ডেসপারেট হয়ে উঠেছেন কেন? এখানেও এই তদন্ত কমিশনের কাজ বন্ধ করার জন্য ড. ইউনূসের দাবির সমর্থনে এগিয়ে এসেছে বিএনপি। তারা একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে চায় এবং গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কিত তদন্ত কমিশনের কাজও বন্ধ করতে চায়। এ দুয়ের মাঝে যোগসাজশটা কি?
গ্রামীণ ব্যাংক সংক্রান্ত প্রস্তাবিত তদন্ত কমিশনের কাজ বন্ধ করানোর জন্য ড. ইউনূস যে কতটা ডেসপারেট, তা বোঝা যায় গত ৩১ মে ঢাকার একাধিক দৈনিকে এই তদন্ত বাতিল করার দাবিতে তিনি নিজে একটি প্রবন্ধ লিখেই ভীতিমুক্ত হননি। দেশের মুখচেনা কিছু সংখ্যক সাংবাদিক ও কলামিস্ট দ্বারা এই ব্যাপারে একটা ক্যাম্পেন সৃষ্টিরও চেষ্টা চালাচ্ছেন। এই ক্যাম্পেনারদের অধিকাংশই হয় বিএনপি-সমর্থক না হয় বিএনপি-ঘেঁষা। 
সর্বশেষ, এই ক্যাম্পেনের অংশ হিসেবেই হয়ত গ্রামীণ ব্যাংক সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের কাজ বন্ধ করার দাবিতে বিএনপির বলয়ের কয়েকজন সাংবাদিক ও কলামিস্টের একটি যুক্ত বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। এই বিবৃতিতে যাঁরা সই করেছেন তাঁদের নাম দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। সাদেক খান থেকে শুরু করে যে ক’জনের নাম বিবৃতিতে রয়েছে। তাঁরা সকলেই বিএনপি-ঘেঁষা সি ক্যাটাগরির সাংবাদিক ও কলামিস্ট। এ ও বি ক্যাটাগরির বিএনপি-ঘেঁষা সাংবাদিক ও কলামিস্টরা কোথায় গেলেন? এমনকি ড. ইউনূসের প্রধান খলিফা হিসেবে পরিচিত ‘নিরপেক্ষ’ বাংলা ও ইংরেজী দৈনিক দুটির সম্পাদকের স্বাক্ষরও এই বিবৃতিতে নেই। তাহলে কি ড. ইউনূস এখন এতই অসহায় যে তাকে সমর্থন কুড়াতে সমাজের তলানি পর্যন্ত নামতে হবে?
বিএনপি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। কিন্তু দেশের জনগণের আসল সমস্যা নিয়ে আন্দোলনে না নেমে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা, তারেক বাঁচাও, ইউনূস বাঁচাও ইত্যাদি বিষয়কে ইস্যু করে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে তারা ক্ষমতায় যেতে পাববেন কি? আমার সন্দেহ আছে। আওয়ামী লীগ যদি নিজেদের ব্যর্থতাগুলো না শুধরে নিজেরাই হারিকিরির পথ বেছে না নেন, তাহলে আগামীতে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার দিবাস্বপ্ন সফল হবে না। আর তারেক রহমানের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া? মানব সভ্যতার ইতিহাসের এই নিদারুণ দুর্ঘটনাটি বাংলাদেশে ঘটবে বলে আমি মনে করি না। 

লন্ডন ॥ মঙ্গলবার, ১২ জুন ২০১২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন